
ছবি: সংগৃহীত
মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘ সহিংসতার পরিশেষে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া ও আশা সৃষ্টি করেছে। এই চুক্তি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ২০ দফা শান্তি পরিকল্পনার ভিত্তিতে বাস্তবায়িত হয়েছে। বুধবার (৮ অক্টোবর) রাতে ট্রাম্প তার সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ট্রুথ সোশ্যালে চুক্তির ঘোষণা দেন।
চুক্তির অধীনে দ্রুত সকল জিম্মি মুক্তি এবং ইসরায়েলি সেনাদের প্রত্যাহারের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। প্রথম ধাপে হামাস ও অন্যান্য ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী গাজায় ২০ জন জীবিত ইসরায়েলি বন্দি এবং ২৮ জনের মরদেহ ফেরত দেবে। এর বিনিময়ে ইসরায়েল এক হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি বন্দি মুক্তি দেবে, যাদের মধ্যে অনেকে ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে আটক রয়েছেন।
চুক্তি মিশরের শার্ম এল-শেখে তিন দিনের পরোক্ষ আলোচনার পর সম্পন্ন হয়। আলোচনায় মিশর, কাতার, তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, “আমি গর্বিত যে ইসরায়েল ও হামাস উভয়ই আমাদের শান্তি পরিকল্পনার প্রথম ধাপে সই করেছে। এটি আরব ও মুসলিম বিশ্ব, ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এক ঐতিহাসিক দিন। গাজা পুনর্নির্মিত হবে এবং মানুষ একে অপরের সঙ্গে মিলেমিশে চলবে—এটি একটি নতুন বিশ্বের সূচনা।”
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেন, “আজ ইসরায়েলের জন্য এক ঐতিহাসিক দিন। আমি সরকারের কাছে আহ্বান জানাবো দ্রুত চুক্তি অনুমোদন করার এবং আমাদের জিম্মিদের ঘরে ফেরানোর।”
হামাস এক বিবৃতিতে কাতার, মিশর, তুরস্ক ও ট্রাম্প প্রশাসনের প্রচেষ্টার প্রশংসা জানিয়ে চুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “আমাদের জনগণের আত্মত্যাগ বৃথা যাবে না—আমরা স্বাধীনতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাবো।”
ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস বলেন, এটি দুই রাষ্ট্র সমাধানের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তিনি কাতার, মিশর, তুরস্ক ও ট্রাম্প প্রশাসনের প্রচেষ্টার প্রশংসা করেছেন এবং গাজা ও পশ্চিম তীরের সংযোগ পুনঃস্থাপনের ওপর জোর দিয়েছেন।
কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, যুদ্ধবিরতি, বন্দি বিনিময় ও মানবিক সহায়তার প্রবেশ বিষয়ে সব দফা এবং বাস্তবায়ন কাঠামোতে চুক্তি হয়েছে।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান বলেন, “আমি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ধন্যবাদ জানাই, যিনি ইসরায়েলকে যুদ্ধবিরতিতে রাজি করানোর জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখিয়েছেন। আমরা চুক্তি কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ করব এবং ১৯৬৭ সালের সীমারেখায় স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংগ্রাম চালিয়ে যাবো।”
সৌদি আরব আশা প্রকাশ করেছে, চুক্তি গাজাবাসীর মানবিক কষ্ট লাঘবে সহায়ক হবে এবং ইসরায়েলি বাহিনী প্রত্যাহার করবে।
মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম বলেন, “মাসের পর মাসের দুর্ভোগের পর এই চুক্তি একটুখানি আশার আলো। সব পক্ষকে এই সুযোগ কাজে লাগাতে হবে।”
ক্রেমলিন মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ জানান, মস্কো চুক্তির প্রথম ধাপকে সমর্থন করছে এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় মধ্যস্থতাকারীদের প্রশংসা করছে।
অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজ বলেন, “এটি আশার এক আলো—আট দশকের সহিংসতা ও সন্ত্রাসের পর এখনই সময় এই চক্র ভাঙার।”
জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুতেরেস বলেন, “আমি যুদ্ধবিরতি ও বন্দিমুক্তি চুক্তি স্বাগত জানাই। এখন জরুরি হলো মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করা এবং গাজায় প্রবেশ নিরবচ্ছিন্ন রাখা। এই চুক্তি যেন দুই রাষ্ট্র সমাধানের পথে স্থায়ী শান্তির সূচনা হয়।”
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বলেন, “চুক্তি যুদ্ধের সমাপ্তি এবং রাজনৈতিক সমাধানের সূচনা ঘটাবে। ফ্রান্স এই প্রচেষ্টায় সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।”
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টার্মার বলেন, “চুক্তির বাস্তবায়ন বিলম্ব ছাড়াই সম্পূর্ণভাবে হতে হবে এবং গাজায় মানবিক সহায়তার ওপর সব নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে হবে।”
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেন,“প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনার প্রথম ধাপ গৃহীত হওয়ায় আমরা স্বাগত জানাই। এটি দীর্ঘস্থায়ী শান্তির পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।”
বিশ্ব নেতাদের প্রতিক্রিয়া স্পষ্টভাবে দেখাচ্ছে, যুদ্ধবিরতি কেবল গাজা অঞ্চলেই নয়, বরং মধ্যপ্রাচ্যের স্থায়ী শান্তির সম্ভাবনাকে শক্তিশালী করছে। চুক্তির সুষ্ঠু বাস্তবায়ন ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ নিশ্চিত হলে মানবিক সহায়তা দ্রুত পৌঁছাবে এবং বন্দি মুক্তির মাধ্যমে দীর্ঘদিনের আঘাতপ্রাপ্ত জনগণ স্বস্তি পাবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই চুক্তি যুদ্ধবিরতি মাত্র নয়, এটি দুই রাষ্ট্র সমাধানের পথে একটি নতুন ধাপের সূচনা এবং ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতাকারীদের জন্য উদাহরণ স্থাপন করবে।
সংক্ষেপে, ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধবিরতি চুক্তি শুধুমাত্র স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা নয়, বরং গাজাবাসীর জীবনমান উন্নয়নের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই চুক্তি কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ করবে এবং আশা করা যাচ্ছে, এটি মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘস্থায়ী স্থিতিশীলতার পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা হিসেবে কাজ করবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ