
ছবি: সংগৃহীত
মোবাইলে আর্থিক লেনদেনের অন্যতম বড় মাধ্যম ‘নগদ’-এর নিয়ন্ত্রণ ফের দুষ্কৃতকারীদের হাতে চলে গেছে—এমনটাই আশঙ্কা প্রকাশ করেছে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আদালতের এক রায়ের ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিষ্ঠানটির ওপর তাদের প্রশাসনিক কর্তৃত্ব হারিয়েছে এবং সেই শূন্যস্থানে সুযোগ নিয়ে পুনরায় নগদের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে একাংশ অভিযুক্ত, যাদের বিরুদ্ধে আগেই অর্থ তছরুপের মামলা করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে করে সাধারণ জনগণের অর্থ এবং দেশের আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, যাদের বিরুদ্ধে নগদে বিপুল অঙ্কের ইলেকট্রনিক অর্থ বা ই-মানি জালিয়াতির অভিযোগে মামলা হয়েছে, তাদের মধ্য থেকেই একজন—সাবেক পরিচালক মো. সাফায়েত আলম—সম্প্রতি নগদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। এর পরপরই তিনি একটি শক্ত অবস্থান গ্রহণ করে নানা পরিবর্তন আনতে শুরু করেছেন। দুই দিনের মধ্যেই বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেন্সিক অডিটে সহায়তাকারী ২৩ জন কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। পাশাপাশি মানবসম্পদ বিভাগসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে আনানো হয়েছে পরিবর্তন।
এই ঘটনার ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, “এই পরিস্থিতিতে ফের অবৈধ ই-মানি তৈরির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।” শনিবার (১৭ মে) এক সংবাদ সম্মেলনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান জানান, ‘‘আমরা এখন নিয়ন্ত্রণহীন। আদালতের নির্দেশে আমাদের প্রশাসককে অপসারণ করতে হয়েছে। আমরা সেই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করেছি। আগামী ১৯ মে সুপ্রিম কোর্টের ফুল বেঞ্চে এ বিষয়ে শুনানি হবে। আশা করি জনগণের স্বার্থেই আদালত পুনর্বিবেচনা করবেন।’’
১৫ মে হাইকোর্ট নগদে নিয়োগকৃত প্রশাসক বাতিলের নির্দেশ দেন। এই আদেশের ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়ন্ত্রক হিসেবে তার নিয়োগকৃত প্রশাসন হারায় এবং প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনার দায়িত্ব ফের পুরনো ব্যবস্থাপনার হাতে চলে যায়। ফলে নিয়ন্ত্রণ হারায় বাংলাদেশ ব্যাংক ও ডাক বিভাগ—দু’টি গুরুত্বপূর্ণ সরকারি প্রতিষ্ঠানই।
এর আগে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর, অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে বাংলাদেশ ব্যাংক ও ডাক বিভাগের নেতৃত্বে নগদে প্রশাসক বসানো হয়। প্রশাসক দলে থাকাকালীন একটি ফরেনসিক অডিটে দেখা যায়, নগদে প্রায় ২,৩৫৬ কোটি টাকার জালিয়াতি হয়েছে। মিথ্যা পরিবেশক ও এজেন্ট তৈরি করে ইচ্ছেমতো ই-মানি সৃষ্টি এবং বিতরণের অভিযোগও প্রমাণিত হয়।
অর্থনীতিবিদ ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “একটি গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক সেবাপ্রতিষ্ঠানে অভিযুক্তদের পুনঃস্থাপন কেবল দুর্নীতির বৈধতা দেয় না, এটি দেশের গোটা আর্থিক খাতের ওপর আস্থা হারানোর সংকেতও পাঠায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ হ্রাস মানে কৌশলগত আর্থিক নিরাপত্তায় ঘাটতি।”
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, “নগদ ছিল সরকারের ডিজিটাল লেনদেনের সফল একটি উদাহরণ। কিন্তু আগের সরকারের আমলে রাজনৈতিক সুবিধাভোগীদের সম্পৃক্ততায় এটি একটি দুর্নীতির ঘাঁটিতে পরিণত হয়। এখন আবার যদি সেই পুরনো গোষ্ঠী ফিরে আসে, তাহলে জনগণের অর্থ মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়বে।”
অ্যাডভোকেট শাহদাত হোসেন, যিনি দেশের আর্থিক খাতে আইনি সংস্কার নিয়ে কাজ করছেন, বলেন, “হাইকোর্টের রায়টি প্রশাসনিক বাস্তবতা না বুঝে দেওয়া হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকই হলো জনগণের অর্থের প্রহরী। সেই প্রহরীকে সরিয়ে ফেলে একজন অভিযুক্তকে নগদের সিইও করা চরম দুর্ভাগ্যজনক। এটি আদালতের ভুল ব্যাখ্যার ফল, যা আপিল বিভাগে সংশোধন হওয়া জরুরি।”
বাংলাদেশ ব্যাংক নগদের বিরুদ্ধে যে মামলা দায়ের করে, তাতে উল্লেখ করা হয় যে সাবেক সরকারের সময় নগদ একচেটিয়া সুবিধা ভোগ করেছে। সরকারি ভাতা বিতরণ, গ্রাহক সংগ্রহ, লাইসেন্সসংক্রান্ত ছাড়সহ নানা ক্ষেত্রে তারা রাজনৈতিক সুবিধার কারণে অতিরিক্ত ই-মানি তৈরি ও অনিয়ম করেছে। এই ঘটনায় নগদের সাবেক চেয়ারম্যান, সাবেক সিইও, ডাক বিভাগের আটজন সাবেক ও বর্তমান ডিজিসহ মোট ২৪ জনকে আসামি করা হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দাবি : জনগণের অর্থের নিরাপত্তা ফেরাতে হবে
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র বলেন, “নগদে বিশৃঙ্খলার কারণে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এটা সরকার বা ব্যাংকের সমস্যা নয়, এটা জনগণের সমস্যা। আমরা আদালতের কাছে আবেদন করেছি—দয়া করে আবার আমাদের নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে দিন। আমরা এই প্রতিষ্ঠানের ভেতরের দুর্নীতি দূর করে জনগণের টাকাকে নিরাপদ করতে চাই।”
আগামী ১৯ মে আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে এই বিষয়ে শুনানি হবে। আদালত যদি হাইকোর্টের আদেশ বাতিল করে, তবে বাংলাদেশ ব্যাংক আবারো নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে পারে। না হলে নগদের ওপর আর্থিক নিয়ন্ত্রণ হারানোর মধ্য দিয়ে দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ সেবাখাতে অস্বচ্ছতা ও দুষ্কৃতির স্থায়ী আসন তৈরি হতে পারে—এমন আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এই পরিস্থিতিতে আর্থিক খাতের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং নাগরিক আস্থার প্রশ্নে এই মামলা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ইতিহাসে একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ