ছবি: সংগৃহীত
রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের অনুমোদনক্রমে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আইন-২০০৪-এ একটি ব্যাপক ও গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী আনা হয়েছে। বুধবার (২৩ ডিসেম্বর) জারি হওয়া নতুন অধ্যাদেশে কমিশনের গঠন, নিয়োগ পদ্ধতি, কার্যাবলি এবং বিশেষ করে মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত অপরাধের তদন্তে এর ক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তন ও সম্প্রসারণ করা হয়েছে। এই সংশোধনীর মাধ্যমে দুদককে একটি শক্তিশালী ও যুগোপযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞ মহল মনে করছেন।
কমিশনের গঠনে আমূল পরিবর্তন: সংশোধিত অধ্যাদেশে দুদক কমিশনের গঠন কাঠামোতে বড় ধরনের রদবদল ঘটানো হয়েছে। আগের আইনের ৫ নং ধারা সংশোধন করে এখন থেকে একজন চেয়ারম্যানসহ সর্বোচ্চ পাঁচ সদস্যের কমিশন গঠনের বিধান রাখা হয়েছে। এই পাঁচ সদস্যের মধ্যে অবশ্যই একজন নারী কমিশনার এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিষয়ে উচ্চ পর্যায়ের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন কমিশনার থাকতে হবে। কমিশনারদের মধ্য থেকে রাষ্ট্রপতি একজনকে চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেবেন। এই পরিবর্তনটি কমিশনে নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার পাশাপাশি ডিজিটাল যুগের অপরাধ ও আর্থিক লেনদেন তদন্তে প্রযুক্তিগত বিশেষজ্ঞতাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে।
যাচাই-বাছাই কমিটিতে পরিবর্তন: কমিশনার নিয়োগের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ‘সার্চ কমিটি’র নাম ও গঠনও বদলে দেওয়া হয়েছে। নতুন আইনে এটিকে ‘যাচাই-বাছাই কমিটি’ নামে অভিহিত করা হয়েছে এবং এর সদস্য পদের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনা হয়েছে। কমিটির সভাপতি হবেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন জ্যেষ্ঠ বিচারক (সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি নন)। কমিটির অন্যান্য সদস্যরা হবেন: প্রধান বিচারপতি কর্তৃক মনোনীত হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারক, বাংলাদেশের মহা হিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান এবং জাতীয় সংসদের স্পিকার কর্তৃক সরকারি দল ও প্রধান বিরোধী দলের মতামতের ভিত্তিতে মনোনীত দুই জন সংসদ সদস্য (একজন সরকার দলীয় ও অন্যজন বিরোধী দলীয়)। তবে, সংসদ ভেঙে যাওয়া অবস্থায় প্রয়োজন হলে সংসদ সদস্য ছাড়াই এই কমিটি গঠনের সুযোগ রাখা হয়েছে।
এনফোর্সমেন্ট ও গোয়েন্দা কার্যক্রম আইনি স্বীকৃতি পেল: দুদকের কার্যাবলির ক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সংযোজন হলো এনফোর্সমেন্ট ও গোয়েন্দা (ইনটেলিজেন্স) কার্যক্রম পরিচালনার বিষয়টি সরাসরি আইনের ৩ নং ধারার আওতায় আনা হয়েছে। এর আগে বিধি বা প্রবিধানের মাধ্যমে এই কার্যক্রম চালানো হতো। সরাসরি প্রধান আইনে এই ক্ষমতা যুক্ত হওয়ায় দুদকের তদন্ত ও তথ্য সংগ্রহ প্রক্রিয়া আরও শক্তিশালী ও বিধিবদ্ধ ভিত্তি পেয়েছে।
মানিলন্ডারিং তদন্তের ক্ষমতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি: সংশোধনীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত অপরাধের অনুসন্ধান ও তদন্তে দুদকের এখতিয়ার ব্যাপকভাবে বাড়ানো হয়েছে। আইনের তফসিলে (শিডিউল) পরিবর্তন এনে একাধিক নতুন ধরনের অপরাধকে দুদকের এখতিয়ারভুক্ত করা হয়েছে। আগে শুধু ‘ঘুষ ও দুর্নীতি’ থেকে উদ্ভূত মানিলন্ডারিং অপরাধই দুদক তদন্ত করতে পারত। নতুন তফসিলে (ঘ) দফা অনুযায়ী, মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর অধীন নিম্নলিখিত অপরাধগুলোও এখন দুদকের তদন্তের আওতায় আসবে:
-
দলিল-দস্তাবেজ জালকরণ, প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থের মানিলন্ডারিং।
-
দেশি-বিদেশি মুদ্রা পাচার, চোরাচালান ও শুল্ক সংক্রান্ত অপরাধ থেকে সৃষ্ট মানিলন্ডারিং।
-
কর সংক্রান্ত বিভিন্ন অপরাধ (ট্যাক্স ইভেশন) থেকে প্রাপ্ত অর্থের মানিলন্ডারিং।
-
পুঁজিবাজার সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ অপরাধ: পুঁজিবাজারের মূল্য সংবেদনশীল তথ্য জনসম্মুখে প্রকাশের আগে তা কাজে লাগিয়ে শেয়ার লেনদেনের মাধ্যমে বাজার থেকে অস্বাভাবিক সুবিধা (ইনসাইডার ট্রেডিং) আদায় এবং ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধার লক্ষ্যে বাজারকে কৃত্রিমভাবে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা (মার্কেট ম্যানিপুলেশন) সংক্রান্ত অপরাধ।
এই সম্প্রসারণের মাধ্যমে দুদক এখন শুধু দুর্নীতির সরাসরি আয় নয়, বরং অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক খাতের জটিল অপরাধ থেকেও উদ্ভূত মানিলন্ডারিংয়ের বিরুদ্ধে কার্যকরভাবে লড়াই করতে সক্ষম হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
সংস্কার কমিশনের সুপারিশ ও পরবর্তী প্রতিক্রিয়া: উল্লেখ্য, ২০২৪ সালের অক্টোবরে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানের নেতৃত্বে গঠিত একটি সংস্কার কমিশন দুদকের আমূল পরিবর্তনের জন্য ৪৭টি সুপারিশ করে। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত সেই প্রতিবেদনে দুদককে একটি স্বাধীন, সাংবিধানিক ও কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে ব্যাপক সুপারিশ ছিল। যদিও নতুন এই অধ্যাদেশে কিছু কাঠামোগত সংস্কার আনা হলেও, স্বাধীনতা ও জবাবদিহিতামূলক কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ অন্তর্ভুক্ত হয়নি। গত ২৮ নভেম্বর অধ্যাদেশের খসড়া থেকে এমন কিছু কৌশলগত সুপারিশ বাদ পড়ায় টিআইবি তাদের গভীর ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেছিল।
সর্বোপরি, এই অধ্যাদেশ দুর্নীতি দমনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রধান প্রতিষ্ঠানটির আইনি কাঠামোকে যুগের চাহিদার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করতে একটি বড় পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তবে, এই আইনী কাঠামোগত পরিবর্তন কতটুকু কার্যকর ও স্বাধীনভাবে বাস্তবায়িত হয়, এবং তা দুর্নীতি ও মানিলন্ডারিং বিরোধী লড়াইকে কতটা শক্তিশালী করে, সেটিই এখন দেখার বিষয়।
বাংলাবার্তা/এসজে
.png)
.png)
.png)



