ছবি: সংগৃহীত
দাবি আদায়ে শুল্ক কর্মকর্তাদের কর্মবিরতি, পরিবহন ধর্মঘট এবং নানা প্রশাসনিক সংকটের মধ্যেও ২০২৫ সালে কনটেইনার ও কার্গো হ্যান্ডলিংয়ে নতুন ইতিহাস গড়েছে চট্টগ্রাম বন্দর। দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরটি শুধু কনটেইনার ও বাল্ক কার্গো পরিবহনেই নয়, জাহাজ হ্যান্ডলিংয়ের ক্ষেত্রেও আগের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। একই সঙ্গে আগের বছরের তুলনায় বন্দরে জাহাজ আগমনের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।
বন্দর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বছরজুড়ে নানা প্রতিকূলতা থাকলেও দ্রুত সিদ্ধান্ত, ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন এবং প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর ফলে চট্টগ্রাম বন্দর আবারও তার সক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছে। তবে এই প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে নৌচ্যানেলের নাব্যতা বৃদ্ধি এবং জেটি ও ইয়ার্ডে আধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপনের বিকল্প নেই বলেও মত দিয়েছেন ব্যবসায়ী ও শিপিং খাতের নেতারা।
দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ২০২৫ সালে আমদানি–রফতানি বাণিজ্যে বড় কোনো নেতিবাচক প্রভাব না ফেললেও বছরের মাঝামাঝিতে শুল্ক কর্মকর্তাদের কর্মবিরতি ও পরিবহন ধর্মঘট চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রমে কিছুটা চাপ সৃষ্টি করে। কয়েক সপ্তাহ বন্দরের গেট ও ইয়ার্ডে পণ্য জটের আশঙ্কা দেখা দিলেও বন্দর কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সমন্বিত উদ্যোগে দ্রুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। এরপরই পুরোদমে গতি ফিরে পায় বন্দরের কার্যক্রম।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত বন্দরে ৩৩ লাখের বেশি কনটেইনার হ্যান্ডলিং করা হয়েছে। একই সময়ে হ্যান্ডলিং করা হয়েছে প্রায় ১৩ লাখ ৩৯ হাজার মেট্রিক টন কার্গো পণ্য। এ ছাড়া বন্দরে ভিড়েছে ৪ হাজার ৩০০টিরও বেশি দেশি-বিদেশি জাহাজ, যা চট্টগ্রাম বন্দরের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (হারবার ও মেরিন) কমোডর আমিন আহমেদ আবদুল্লাহ জানান, ২০২৫ ক্যালেন্ডার ইয়ারে জাহাজ, কনটেইনার ও কার্গো হ্যান্ডলিং—সব ক্ষেত্রেই আগের বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তিনি বলেন, “ইতোমধ্যে চার হাজারের বেশি জাহাজ হ্যান্ডলিং করা হয়েছে। বাল্ক কার্গোর ক্ষেত্রে ১৩ কোটি ২৭ লাখ ৫ হাজার মেট্রিক টনের বেশি পণ্য এবং ৩৩ লাখের বেশি কনটেইনার হ্যান্ডলিং সম্পন্ন হয়েছে। অর্থবছর শেষে কনটেইনারের সংখ্যা ৩৪ লাখ ছাড়িয়ে যাবে বলে আমাদের ধারণা।”
এই সাফল্যের পেছনে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন বড় ভূমিকা রেখেছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, বন্দরের গেট অপারেশন ও পিয়ারসাইড অপারেশনকে অটোমেশনের আওতায় আনা হয়েছে। কাস্টমস কর্তৃপক্ষের সঙ্গে নিবিড় সমন্বয়ের মাধ্যমে ইয়ার্ড ম্যানেজমেন্ট নতুনভাবে সাজানো হয়েছে। প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা দূর করে উদ্ভাবনী উদ্যোগ নেওয়ায় বন্দরের সক্ষমতা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের পাশাপাশি দেশের ২১টি বেসরকারি অফডকও চলতি বছর কনটেইনার ও বাল্ক কার্গো হ্যান্ডলিংয়ে নতুন রেকর্ড গড়েছে। সংশ্লিষ্টদের ধারণা, বছর শেষে অফডকগুলোতে রফতানি পণ্যে প্রায় ৬ দশমিক ৪ শতাংশ এবং আমদানি পণ্যে প্রায় ১৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে। তবে এখানেও রফতানির তুলনায় আমদানির চাপ বেশি ছিল।
বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশনের (বিকডা) মহাসচিব রুহুল আমিন সিকদার বিপ্লব বলেন, ২০২৫ সালে চট্টগ্রাম বন্দর ও বেসরকারি অফডকগুলোকে একাধিক প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয়েছে। পরিবহন ধর্মঘট ও কাস্টমস কর্মকর্তাদের কর্মবিরতি ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। তবে সব বাধা অতিক্রম করেই আমদানি–রফতানি কার্যক্রম এগিয়ে গেছে।
তিনি আরও বলেন, দেশের সার্বিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, অবকাঠামো প্রকল্প এবং শিল্প খাতের চাহিদার কারণে আমদানি উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ফলে রফতানির তুলনায় আমদানিতে প্রবৃদ্ধি বেশি দেখা গেছে। স্টেকহোল্ডারদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও দায়িত্বশীলতার কারণেই এই অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
এদিকে প্রায় ৩৯ বছর পর চট্টগ্রাম বন্দরের ট্যারিফ বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েও ২০২৫ সালে নানা বিতর্ক ও জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। ব্যবহারকারীদের একটি অংশ বলছে, আঞ্চলিক প্রতিযোগী দেশগুলোর বন্দরের তুলনায় চট্টগ্রাম বন্দরের খরচ তুলনামূলক বেশি হয়ে যাচ্ছে। তাই ট্যারিফ বাড়ানোর পাশাপাশি সেবার মান দৃশ্যমানভাবে উন্নত করার দাবি তুলেছেন তারা।
বিজিএমইএর প্রথম সহ-সভাপতি সেলিম রহমান বলেন, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ভারত কিংবা ভিয়েতনামের বন্দরের তুলনায় চট্টগ্রাম বন্দরের খরচ বেশি। “ব্যবহারকারীরা বেশি অর্থ পরিশোধ করলেও আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী সেবার উন্নয়ন প্রত্যাশিত হারে হচ্ছে না। ট্যারিফ বাড়ালে সেবার মানেও স্পষ্ট উন্নয়ন দেখতে হবে,”—বলেন তিনি।
শিপিং ও লজিস্টিকস খাতের ব্যবসায়ীরা মনে করেন, দেশের আমদানি–রফতানি বাণিজ্যের ভবিষ্যৎ সুরক্ষায় চট্টগ্রাম বন্দরের নৌচ্যানেলে নিয়মিত ড্রেজিং অত্যন্ত জরুরি। নাব্য সংকট কাটিয়ে অন্তত ১০ মিটার গভীরতার জাহাজ চলাচলের ব্যবস্থা করতে না পারলে বন্দরের সক্ষমতা পুরোপুরি কাজে লাগানো সম্ভব হবে না।
রেডিয়্যান্ট শিপিং লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিকুল আলম জুয়েল বলেন, নাব্য সংকট নিরসনে ড্রেজিং কার্যক্রম ধারাবাহিকভাবে চালিয়ে যেতে হবে। বড় জাহাজ যাতে সহজে জেটিতে ভিড়তে পারে, সে ব্যবস্থাও নিশ্চিত করা জরুরি। পাশাপাশি জিসিপি ও অন্যান্য ইয়ার্ডে গ্যান্ট্রি ক্রেনসহ আধুনিক যন্ত্রপাতির ঘাটতি রয়েছে, যা দ্রুত পূরণ করা প্রয়োজন।
তিনি আরও বলেন, বন্দরের কাছে প্রয়োজনীয় অর্থ ও সক্ষমতা রয়েছে। তাই যন্ত্রপাতি ক্রয় ও রক্ষণাবেক্ষণে ধারাবাহিক বিনিয়োগ নিশ্চিত করা গেলে ২০২৬ সালের মধ্যেই চট্টগ্রাম বন্দর আরও শক্ত অবস্থানে পৌঁছাবে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বন্দরের সুনাম বাড়বে।
উল্লেখ্য, দেশের মোট আমদানি–রফতানি বাণিজ্যের প্রায় ৯৩ শতাংশই সম্পন্ন হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। বছরে এই বাণিজ্যের আর্থিক পরিমাণ দুই লাখ কোটি টাকারও বেশি। আন্তর্জাতিক শিপিং সাময়িকী লয়েড লিস্ট-এর তালিকা অনুযায়ী, বিশ্বের ব্যস্ততম ১০০টি বন্দরের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থান বর্তমানে ৬৮তম। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, অবকাঠামো ও ব্যবস্থাপনায় আরও উন্নয়ন হলে এই অবস্থান আরও উপরের দিকে নেওয়া সম্ভব।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



