ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে বহুল আলোচিত অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তি (ইকোনমিক পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট—ইপিএ) চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। চুক্তির খসড়া ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে এবং আগামী মাসেই দুই দেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। এই চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের রপ্তানি, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছে সরকার।
সোমবার (২২ ডিসেম্বর) দুপুরে সচিবালয়ের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলনকক্ষে বাংলাদেশ-জাপান অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তি নিয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বাণিজ্য উপদেষ্টা এসব তথ্য জানান। সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়সংক্রান্ত বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন এবং বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, জাপানের সঙ্গে এই ইপিএ চুক্তি বাংলাদেশের জন্য একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক। কারণ এই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ কোনো উন্নত দেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তিতে যাচ্ছে। এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশ) থেকে উত্তরণের প্রাক্কালে এই চুক্তি বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সক্ষমতা ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ জাপানের জন্য ৯৭টি উপখাত উন্মুক্ত করতে সম্মত হয়েছে। এর ফলে জাপানি বিনিয়োগকারীরা শিল্প, সেবা ও অন্যান্য সম্ভাবনাময় খাতে বাংলাদেশে আরও সহজে বিনিয়োগ করতে পারবেন। অন্যদিকে জাপান বাংলাদেশের জন্য ১২০টি উপখাত উন্মুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের জন্য বিশাল সুযোগ তৈরি করবে।
সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, এই চুক্তি কার্যকর হলে প্রথম দিন থেকেই বাংলাদেশের ৭ হাজার ৩৭৯টি পণ্য জাপানের বাজারে তাৎক্ষণিক শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পাবে। এর ফলে তৈরি পোশাক, চামড়াজাত পণ্য, কৃষিপণ্য, হালকা প্রকৌশল, প্লাস্টিক ও অন্যান্য বহুমুখী পণ্যের রপ্তানি উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। অন্যদিকে জাপানের ১ হাজার ৩৯টি পণ্য বাংলাদেশের বাজারে তাৎক্ষণিক শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে, যা দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ভারসাম্য ও পারস্পরিক সহযোগিতা আরও জোরদার করবে।
সংবাদ সম্মেলনে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, ‘দীর্ঘ ও তীব্র দর-কষাকষির মধ্য দিয়ে আমরা জাপানের সঙ্গে ইপিএ চুক্তির খসড়া চূড়ান্ত করতে সক্ষম হয়েছি। এটি সহজ ছিল না। জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আজ আমার ফোনে কথা হয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী মাসেই এই চুক্তি স্বাক্ষর হবে।’ তিনি আরও বলেন, এই চুক্তির ফলে বাংলাদেশে জাপানি বিনিয়োগ বাড়বে, নতুন শিল্প স্থাপিত হবে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। পাশাপাশি দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণও উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে।
প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়সংক্রান্ত বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী বলেন, এ ধরনের অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তির অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের আগে ছিল না। তিনি বলেন, ‘আমরা আগে কখনো এই ধরনের ইপিএ করিনি। ফলে শুরুতে কীভাবে এগোতে হবে, সেটি আমাদের অনেকের কাছেই পরিষ্কার ছিল না। তবে এই সরকারের সম্মিলিত ও আন্তরিক প্রচেষ্টায় আমরা তা সফলভাবে সম্পন্ন করতে পেরেছি।’ তিনি এই চুক্তিকে বাংলাদেশের জন্য একটি শক্তিশালী ও ইতিবাচক চুক্তি হিসেবে উল্লেখ করেন।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন বলেন, জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকলেও বাস্তবে জাপানি বিনিয়োগের পরিমাণ খুব বেশি নয়। বর্তমানে বাংলাদেশে জাপানের মোট বিনিয়োগ প্রায় ৫০ কোটি ডলার, যা বিশ্বের অন্যান্য দেশে জাপানের বিনিয়োগের তুলনায় নগণ্য। তিনি বলেন, আগে বাংলাদেশ যখন জাপানের কাছে বেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের চেষ্টা করত, তখন প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক ও আইনি কাঠামোর অভাব ছিল। এই ইপিএ চুক্তি সেই ঘাটতি পূরণ করবে।
চৌধুরী আশিক আরও বলেন, বাংলাদেশকে প্রায়ই ভিয়েতনামের সঙ্গে তুলনা করা হয়। কিন্তু ভিয়েতনামের সঙ্গে বিশ্বের প্রায় ৩০টি দেশের অর্থনৈতিক চুক্তি রয়েছে, যার কারণে দেশটি বিপুল পরিমাণ বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পেরেছে। বাংলাদেশ মাত্র সেই পথে যাত্রা শুরু করল। তাঁর আশা, জাপানের সঙ্গে এই ইপিএ চুক্তি ভবিষ্যতে অন্যান্য উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের সঙ্গে আরও চুক্তির পথ সুগম করবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, এই চুক্তি কার্যকর হলে বাংলাদেশের এলডিসি উত্তরণের পর শুল্কমুক্ত সুবিধা হারানোর যে আশঙ্কা রয়েছে, তা অনেকটাই মোকাবিলা করা সম্ভব হবে। একই সঙ্গে রপ্তানি পণ্যের বৈচিত্র্য বাড়বে, শিল্পায়ন ত্বরান্বিত হবে এবং বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের নতুন উৎস সৃষ্টি হবে।
সার্বিকভাবে, বাংলাদেশ-জাপান অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তিকে দেশের বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হিসেবে দেখছেন নীতিনির্ধারক ও অর্থনীতিবিদরা। এই চুক্তির সফল বাস্তবায়ন বাংলাদেশের বৈশ্বিক অর্থনীতিতে আরও শক্ত অবস্থান তৈরি করবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



