ছবি: সংগৃহীত
সঙ্কোচনমূলক মুদ্রানীতি ও সরকারের কৃচ্ছ্রসাধনমূলক ব্যয় ব্যবস্থাপনার প্রভাবে চলতি অর্থবছরের শেষ দিকে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশের নিচে নেমে আসতে পারে বলে আশা প্রকাশ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, মূল্যস্ফীতির প্রবণতা, বাজেট বাস্তবায়ন এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ওপর এর প্রভাব নিয়ে সোমবার (২২ ডিসেম্বর) প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি উচ্চপর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ, পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে দেশের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক অগ্রগতি, রাজস্ব আদায়, সরকারি ব্যয় নিয়ন্ত্রণ, মুদ্রানীতির কার্যকারিতা এবং মূল্যস্ফীতির ভবিষ্যৎ গতিপ্রকৃতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।
বৈঠক শেষে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, টানা দীর্ঘ সময় উচ্চ পর্যায়ে থাকার পর দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি ধীরে ধীরে নিম্নমুখী হতে শুরু করেছে। ১২ মাসের গড় হিসাবে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি ২০২৩ সালের জুনের পর প্রথমবারের মতো গত নভেম্বর মাসে ৯ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে, যা অর্থনীতির জন্য একটি ইতিবাচক ইঙ্গিত হিসেবে দেখা হচ্ছে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিতে ২০২৩ সালের মার্চ মাসে দেশে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের সীমা অতিক্রম করে ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশে পৌঁছায়। এরপর বিভিন্ন নীতিগত পদক্ষেপ, বিশেষ করে সুদের হার বৃদ্ধি, ঋণ প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ এবং অপ্রয়োজনীয় সরকারি ব্যয় সংকোচনের ফলে মূল্যস্ফীতির চাপ কিছুটা কমতে শুরু করে। এর ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের জুন মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি আবার ৯ শতাংশের নিচে নেমে আসে এবং নভেম্বর মাসে তা আরও কমে দাঁড়ায় ৮ দশমিক ২৯ শতাংশে।
সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, চলমান সঙ্কোচনমূলক মুদ্রানীতি ও কৃচ্ছ্রসাধন অব্যাহত থাকলে ২০২৬ সালের জুন নাগাদ সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে সরকার আশাবাদী। এই লক্ষ্য অর্জনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয় সমন্বিতভাবে কাজ করছে।
তবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে নভেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতির হার সামান্য ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিতে নভেম্বর মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ২৯ শতাংশ, যা আগের মাস অক্টোবরের ৮ দশমিক ১৭ শতাংশের তুলনায় কিছুটা বেশি। বিশেষ করে খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতি অক্টোবরের ৭ দশমিক ০৮ শতাংশ থেকে নভেম্বর মাসে বেড়ে ৭ দশমিক ৩৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
অন্যদিকে খাদ্যবহির্ভূত খাতে মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা কমেছে। অক্টোবর মাসে যেখানে এই খাতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ১৩ শতাংশ, সেখানে নভেম্বর মাসে তা সামান্য কমে ৯ দশমিক ০৮ শতাংশে নেমে এসেছে। বিশ্লেষকদের মতে, জ্বালানি, পরিবহন ও সেবা খাতে কিছুটা স্থিতিশীলতা আসায় খাদ্যবহির্ভূত খাতে মূল্যস্ফীতির চাপ তুলনামূলকভাবে কমেছে।
উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছেন খেটে খাওয়া ও নিম্ন আয়ের মানুষ। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ায় সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। বৈঠকে এই বিষয়টিও গুরুত্ব দিয়ে আলোচিত হয়। বিশেষ করে মূল্যস্ফীতির তুলনায় মজুরি বৃদ্ধির হার কম থাকায় গত কয়েক বছরে মানুষের প্রকৃত আয় কমে যাওয়ার বিষয়টি তুলে ধরা হয়।
প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বিগত কয়েক বছরে মূল্যস্ফীতি ও মজুরি প্রবৃদ্ধির হারের মধ্যে ব্যবধান ছিল উল্লেখযোগ্য, যার ফলে মানুষের প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে চলতি অর্থবছরের সাম্প্রতিক মাসগুলোতে এই ব্যবধান অনেকটাই কমে এসেছে, যা একটি ইতিবাচক পরিবর্তন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ নভেম্বর ২০২৫ মাসে পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতি ও মজুরি প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৮ দশমিক ২৯ শতাংশ ও ৮ দশমিক ০৪ শতাংশ। অথচ ২০২২-২৩ অর্থবছরে গড় হিসাবে এই হার ছিল যথাক্রমে ৯ দশমিক ০২ শতাংশ ও ৭ দশমিক ০৪ শতাংশ। অর্থাৎ তখন মূল্যস্ফীতির তুলনায় মজুরি প্রবৃদ্ধি অনেক পিছিয়ে ছিল।
বৈঠকে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলা হয়, চলতি অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির চাপ ধীরে ধীরে কমতে থাকলে এবং মজুরি প্রবৃদ্ধি বর্তমান ধারা বজায় রাখলে মানুষের প্রকৃত আয় পুনরুদ্ধারের একটি সুযোগ তৈরি হবে। সরকারের নীতিগত উদ্যোগ ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকলে আগামী দিনে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান কিছুটা হলেও স্বস্তিদায়ক হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



