ছবি: সংগৃহীত
চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের শুরু থেকেই রাজস্ব আদায়ে কাঙ্ক্ষিত গতি পাচ্ছে না জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে, অর্থাৎ জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে রাজস্ব আদায়ে বড় ধরনের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। এনবিআরের হালনাগাদ হিসাব অনুযায়ী, এই পাঁচ মাসে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার ৪৭ কোটি টাকা, যা দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিচ্ছে।
এনবিআরের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে মোট ১ লাখ ৭৩ হাজার ২৩ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে বাস্তবে আদায় হয়েছে মাত্র ১ লাখ ৪৮ হাজার ৯৭৬ কোটি টাকা। ফলে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আদায়ে ঘাটতি হয়েছে ২৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি। রোববার (২১ ডিসেম্বর) প্রকাশিত এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের সর্বশেষ প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।
পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে কোনো মাসেই রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব হয়নি। অর্থাৎ মাসভিত্তিক হিসাবেও এনবিআর ধারাবাহিকভাবে পিছিয়ে রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আমদানি শুল্ক, মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট বা মূসক) এবং আয়কর—রাজস্বের এই তিনটি প্রধান খাতের কোনোটিতেই নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জন হয়নি। বরং প্রতিটি খাতেই উল্লেখযোগ্য ঘাটতি রয়ে গেছে।
রাজস্ব ঘাটতির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চাপ তৈরি হয়েছে আয়কর খাতে। আলোচ্য পাঁচ মাসে আয়কর থেকে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫৯ হাজার ৯৯৫ কোটি টাকা। কিন্তু বাস্তবে আদায় হয়েছে ৪৭ হাজার ৮৮১ কোটি টাকা। ফলে এই খাতে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ১১৪ কোটি টাকা, যা মোট ঘাটতির একটি বড় অংশ। অর্থনীতিবিদদের মতে, ব্যক্তি ও করপোরেট আয়কর আদায়ে এই ঘাটতি কর ব্যবস্থার দুর্বলতা ও করদাতাদের পরিপালন সমস্যার ইঙ্গিত দেয়।
এ ছাড়া আমদানি শুল্ক আদায়েও বড় ধরনের ঘাটতি লক্ষ্য করা গেছে। জুলাই-নভেম্বর সময়ে আমদানি খাতে এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫০ হাজার ৯৭৯ কোটি টাকা। কিন্তু এই সময়ে আদায় হয়েছে ৪২ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা। ফলে আমদানি শুল্ক খাতে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ১১৫ কোটি টাকা। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে শ্লথগতি, আমদানি ব্যয় কমে যাওয়া এবং ডলার সংকটের প্রভাব এই ঘাটতির পেছনে ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ভ্যাট বা মূসক খাতেও লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। পাঁচ মাসে ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্য ছিল ৬২ হাজার ৪৮ কোটি টাকা। এর বিপরীতে আদায় হয়েছে ৫৮ হাজার ২৩১ কোটি টাকা। অর্থাৎ এই খাতেও প্রায় ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকার ঘাটতি তৈরি হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা, ভোক্তা চাহিদা কমে যাওয়া এবং উৎপাদন খাতে ধীরগতির প্রভাব ভ্যাট আদায়ের ওপর পড়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরে এনবিআরের জন্য শুল্ক ও কর বাবদ মোট ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সরকার। তবে অর্থবছরের শুরুতেই এমন বড় ঘাটতি তৈরি হওয়ায় এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে লক্ষ্যমাত্রা থেকে এতটা পিছিয়ে পড়া ভবিষ্যতের রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় চাপ বাড়াতে পারে বলে মনে করছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা।
এনবিআরের কর্মকর্তারা অবশ্য পরিস্থিতি নিয়ে আশাবাদী। তাঁদের মতে, সাম্প্রতিক সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্যে শ্লথগতি থাকায় রাজস্ব আদায় তুলনামূলক কম হয়েছে। তবে অর্থবছরের শেষের দিকে অর্থনৈতিক কার্যক্রম বাড়লে রাজস্ব আদায়েও গতি আসবে বলে তাঁরা আশা করছেন। পাশাপাশি করের আওতা বৃদ্ধি, কর পরিপালন নিশ্চিতকরণ, কর ফাঁকি প্রতিরোধ এবং ফাঁকি দেওয়া রাজস্ব পুনরুদ্ধারের জন্য এনবিআর বিভিন্ন কার্যক্রম জোরদার করছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
তবে বাস্তবতা হলো, চলমান অর্থনৈতিক চাপ, মূল্যস্ফীতি, বিনিয়োগে স্থবিরতা এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে রাজস্ব আদায়ের এই ঘাটতি সরকারের বাজেট বাস্তবায়নে নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে। এখন দেখার বিষয়, বছরের বাকি সময়ে এনবিআর কতটা দক্ষতার সঙ্গে এই ঘাটতি কাটিয়ে উঠে নির্ধারিত রাজস্ব লক্ষ্যের কাছাকাছি যেতে পারে।
বাংলাবার্তা/এসজে
.png)
.png)
.png)



