ছবি: সংগৃহীত
ডিসেম্বর মাস এলেই দেশের ব্যাংক গ্রাহকদের একটি বড় অংশের মধ্যে একই ধরনের প্রশ্ন ও দুশ্চিন্তা দেখা দেয়—হঠাৎ করে কেন ব্যাংক হিসাব থেকে টাকা কেটে নেওয়া হলো? আসলে প্রতিবছরের মতো এবারও ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে ব্যাংক হিসাব থেকে আবগারি শুল্ক কাটা শুরু হবে। ব্যাংকগুলো গ্রাহকের মুঠোফোনে খুদে বার্তা (এসএমএস) পাঠিয়ে বিষয়টি জানালেও অনেকেই নিয়মটি পরিষ্কারভাবে না জানার কারণে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন।
ব্যাংক সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, সাধারণত ডিসেম্বরের দুই সপ্তাহ পার হওয়ার পর, অর্থাৎ শেষ সপ্তাহ থেকেই এই শুল্ক কাটা শুরু হয়। মূলত যেসব ব্যাংক হিসাবে নির্ধারিত সীমার বেশি টাকা রয়েছে, সেসব হিসাব থেকেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে আবগারি শুল্ক কেটে সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হয়।
নতুন নিয়মে কারা শুল্ক দেবেন
চলতি অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংক হিসাবের ওপর আবগারি শুল্ক আরোপের নিয়মে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হয়েছে। আগে কোনো ব্যাংক হিসাবে বছরের যেকোনো সময় এক লাখ টাকার বেশি টাকা থাকলেই আবগারি শুল্ক কাটা হতো। কিন্তু জুনে ঘোষিত নতুন বাজেট অনুযায়ী, এখন থেকে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যাংক হিসাব শুল্কমুক্ত রাখা হয়েছে।
অর্থাৎ ২০২৫ সালের মধ্যে যদি আপনার ব্যাংক হিসাব একবারও তিন লাখ টাকা অতিক্রম না করে, তাহলে কোনো আবগারি শুল্ক কাটা হবে না। এই পরিবর্তনের ফলে মধ্যবিত্ত ও ছোট সঞ্চয়কারীরা কিছুটা স্বস্তি পেয়েছেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
আবগারি শুল্ক কী
আবগারি শুল্ক হলো সরকারের আরোপিত এক ধরনের পরোক্ষ কর। এটি কোনো ব্যক্তির আয় বা মুনাফার ওপর নয়, বরং নির্দিষ্ট কিছু পণ্য, সেবা বা আর্থিক সুবিধা ব্যবহারের ওপর ধার্য করা হয়। যেমন—
-
ব্যাংক হিসাবে টাকা রাখা
-
মোবাইল ফোনে কথা বলা
-
তামাকজাত পণ্য ব্যবহার
ব্যাংকের ক্ষেত্রে, এই শুল্ক মূলত ব্যাংকিং সুবিধা ব্যবহারের বিপরীতে নেওয়া হয়। গ্রাহক সরাসরি সরকারকে এই টাকা দেন না; বরং ব্যাংক স্বয়ংক্রিয়ভাবে হিসাব থেকে কেটে নিয়ে তা সরকারি কোষাগারে জমা দেয়।
কোন হিসাবে কত শুল্ক কাটবে
নতুন নিয়ম অনুযায়ী ব্যাংক হিসাবের সর্বোচ্চ স্থিতির ওপর ভিত্তি করে আবগারি শুল্ক নির্ধারণ করা হয়। বছরের যেকোনো এক সময় যদি আপনার হিসাবে নিচের পরিমাণ টাকা থাকে, তাহলে নিম্নোক্ত হারে শুল্ক কাটা হবে—
-
৩ লাখ ১ টাকা থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত: ১৫০ টাকা
-
৫ লাখ ১ টাকা থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত: ৫০০ টাকা
-
১০ লাখ ১ টাকা থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত: ৩ হাজার টাকা
-
৫০ লাখ ১ টাকা থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত: ৫ হাজার টাকা
-
১ কোটি ১ টাকা থেকে ২ কোটি টাকা পর্যন্ত: ১০ হাজার টাকা
-
২ কোটি ১ টাকা থেকে ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত: ২০ হাজার টাকা
-
৫ কোটি টাকার বেশি: ৫০ হাজার টাকা
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, হিসাবের টাকা পরে কমে গেলেও যদি একবার নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করে, তাহলে সেই স্তরের শুল্কই কাটা হবে।
কখন ও কীভাবে শুল্ক কাটা হয়
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আবগারি শুল্ক আরোপ করে। তবে গ্রাহকের কাছ থেকে সরাসরি এনবিআর এই টাকা নেয় না। এনবিআরের পক্ষে ব্যাংকগুলোই গ্রাহকের হিসাব থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে শুল্ক কেটে নেয় এবং তা সরকারি কোষাগারে জমা দেয়।
নিয়ম অনুযায়ী—
-
প্রতি বছর জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর—এই সময়ের মধ্যে হিসাবের সর্বোচ্চ স্থিতি বিবেচনায় নেওয়া হয়
-
কোনো হিসাব একাধিকবার সীমা অতিক্রম করলেও শুল্ক একবারই কাটা হয়
-
শুল্ক কাটার সময় গ্রাহকের মোবাইলে সাধারণত একটি এসএমএস পাঠানো হয়
এই এসএমএস হঠাৎ পেয়ে অনেক গ্রাহকই দুশ্চিন্তায় পড়েন, বিশেষ করে যারা নিয়মটি ভালোভাবে জানেন না।
একাধিক হিসাব থাকলে কী হবে
অনেক গ্রাহকের একাধিক ব্যাংকে হিসাব থাকে। এ ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন—প্রতিটি ব্যাংক হিসাব আলাদাভাবে বিবেচিত হয়।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কারও মোট ১০ লাখ টাকা আছে, কিন্তু তা তিনটি ব্যাংক হিসাবে বিভক্ত—
-
একটি ব্যাংকে ৪ লাখ টাকা
-
অন্য দুইটি ব্যাংকে ৩ লাখ টাকা করে
এই ক্ষেত্রে তিনটি হিসাবই তিন লাখের বেশি হওয়ায়, প্রতিটি হিসাব থেকে ১৫০ টাকা করে আবগারি শুল্ক কাটা হবে। অর্থাৎ মোট শুল্ক দাঁড়াবে ৪৫০ টাকা।
কেন বিভ্রান্তি তৈরি হয়
বিশেষজ্ঞদের মতে, আবগারি শুল্ক কাটার বিষয়টি নিয়ে প্রতিবছর বিভ্রান্তির মূল কারণ হলো পর্যাপ্ত প্রচারের অভাব এবং হঠাৎ করে টাকা কেটে নেওয়ার ঘটনা। অনেক গ্রাহকই মনে করেন এটি ব্যাংকের অতিরিক্ত চার্জ, অথচ বাস্তবে এটি সরকারের নির্ধারিত শুল্ক।
তাই ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে যদি আপনার ব্যাংক হিসাব থেকে নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা কেটে নেওয়া হয়, তবে আতঙ্কিত না হয়ে আগে দেখে নেওয়া উচিত—আপনার হিসাব কি নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করেছিল কি না।
সব মিলিয়ে বলা যায়, নতুন নিয়মে আবগারি শুল্কের সীমা বাড়ানোয় সাধারণ গ্রাহকরা কিছুটা সুবিধা পেলেও ডিসেম্বর এলেই ব্যাংক হিসাবের স্থিতি সম্পর্কে সচেতন থাকা এখন আগের চেয়ে আরও বেশি জরুরি।
বাংলাবার্তা/এসজে
.png)
.png)
.png)



