ছবি: সংগৃহীত
চট্টগ্রাম বন্দর ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৩২ লাখ ৯৬ হাজার টোয়েন্টি ফুট ইকুইভ্যালেন্ট কনটেইনার (টিইইউ) হ্যান্ডলিং করেছে। এর মধ্যে ৯৬ শতাংশ কনটেইনার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক পথে পরিবহন হয়েছে, রেলপথে মাত্র ৩ শতাংশ এবং নৌপথে ১ শতাংশ। যদিও মহাসড়ক দেশের কনটেইনার পরিবহনের প্রধান মাধ্যম, এটি বর্তমানে সক্ষমতার চেয়ে বেশি যানবাহন বহন করছে। চার লেন থাকা সত্ত্বেও সড়কে খানাখন্দ, ধীরগতি ও অযান্ত্রিক যানবাহনের জন্য আলাদা লেন নেই। এছাড়া সড়কের পাশে অনেক হাটবাজার ও আবাসিক এলাকা অবস্থিত। এই অতিরিক্ত চাপ, অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা এবং ব্যবস্থাপনার ঘাটতির কারণে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে পণ্য পরিবহনে বেশি সময় লাগে, যার ফলে পরিবহন খরচও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যানজটের কারণে পণ্য পরিবহনের খরচ ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যাচ্ছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশের আমদানি-রফতানি কার্যক্রম গতিশীল রাখতে মহাসড়কটি অন্তত আট লেনে উন্নীত করা উচিত। যদিও আগের আওয়ামী লীগ সরকার মহাসড়ক প্রশস্ত করার উদ্যোগ নিয়েছিল, তা সমীক্ষা পর্যায়েই আটকে ছিল। অন্যদিকে, দায়িত্বের শেষ সময়ে আসা অন্তর্বর্তী সরকারও মহাসড়ক উন্নয়নে বিনিয়োগে অগ্রসর হয়নি।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক উন্নয়নে গত এক দশকে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। এই বিনিয়োগের মাধ্যমে ২০১৭ সালে সড়কটি দুই লেন থেকে চার লেনে উন্নীত করা হয়। তবে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক উন্নয়নের জন্য যে অর্থ বরাদ্দ হয়েছে, তা প্রকৃত প্রয়োজনের তুলনায় কম। বিগত এক দশকে দেশের অন্যান্য কম গুরুত্বপূর্ণ করিডোরে এই সড়কের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি বিনিয়োগ করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণে খরচ হয়েছে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা, ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করতে ব্যয় হয়েছে ৬ হাজার ১৬৮ কোটি টাকা, টাঙ্গাইল-রংপুর মহাসড়কে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হচ্ছে, এবং ঢাকা-সিলেট সড়ক সম্প্রসারণে খরচ হচ্ছে আরও ১৭ হাজার কোটি টাকা।
শুধু পণ্যবাহী যানবাহন নয়, যাত্রীবাহী যানবাহনের চাপও প্রতিনিয়ত বাড়ছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে। বিষয়টি আমলে নিয়ে ২০২৩ সালের এপ্রিলে সড়কটি সম্প্রসারণের লক্ষ্যে একটি সমীক্ষার কাজ শুরু করে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর। এ কাজে অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এসএমইসির নেতৃত্বে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের একটি কনসোর্টিয়াম নিযুক্ত করা হয়। সমীক্ষায় মহাসড়কটি ছয় বা আট লেনে উন্নীত করার বিষয়টি উঠে আসে এবং এ কাজে প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হতে পারে বলে প্রাক্কলন করা হয়। সমীক্ষার পর সড়কটি উন্নয়নে পরে আর কোনো প্রকল্প আওয়ামী লীগ আমলে অনুমোদিত হয়নি।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার মহাসড়কটির গুরুত্ব অনুধাবন করলেও শেষ সময়ে এসে বড় বিনিয়োগ করতে আগ্রহী নয়। এ প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, ‘আমরা আর দুই মাস আছি। এই সময়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে বড় বিনিয়োগের পরিকল্পনা আমাদের নেই। এটা পরবর্তী সরকারের দায়িত্ব।’ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে বিনিয়োগের পরিকল্পনা থাকলেও সারা দেশে রেল, নৌ ও সড়কপথ মিলিয়ে একটি সমন্বিত মহাপরিকল্পনা তৈরি করা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘শুধু সড়কের ওপর নির্ভর না থেকে পরিবহনের সবগুলো মাধ্যমকে সমন্বিতভাবে ব্যবহারের একটি মহাপরিকল্পনা আমরা তৈরি করছি। কোন কোন খাতে কী ধরনের সীমাবদ্ধতা রয়েছে, সেগুলো আমরা চিহ্নিত করছি এবং প্রয়োজনীয় কী কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া যাবে, তাও মহাপরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করছি।’
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, বর্তমানে যে পরিমাণ যানবাহন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দিয়ে চলছে, তা সক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি। মহাসড়কটির ধারে এখনো প্রচুর বাড়িঘর আছে, হাটবাজার আছে। ধীরগতির যানবাহনের জন্য কিংবা অযান্ত্রিক যানবাহনের জন্য আলাদা কোনো লেন নেই। নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা এ সড়কে বিদ্যমান বলে জানিয়েছেন তারা।
এসব প্রতিবন্ধকতার কারণে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে পণ্য পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা। এ বিষয়ে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির লাইফলাইন হলো ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। এই গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কে যানজট এখন নৈমিত্তিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে প্রতিদিন কর্মঘণ্টার অপচয় হচ্ছে এবং অর্থেরও অপচয় হচ্ছে। যখন এই মহাসড়ককে আট লেনে উন্নীত করা প্রয়োজন ছিল, তখন কেবল চার লেন করা হয়েছে। বর্তমানে চার লেন বা আট লেনও পর্যাপ্ত নয়; প্রয়োজন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, যা সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জকে সংযুক্ত করবে। এছাড়া কমলাপুর থেকে রেলওয়ে কনটেইনার টার্মিনাল দ্রুত সরিয়ে ধীরাশ্রমে চালু করতে হবে এবং পানগাঁও পোর্ট সচল করতে হবে, যা গত ১২ বছরে করা হয়নি।
বাংলাদেশের জাতীয় সমন্বিত বহুমুখী পরিবহন মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের অংশ হিসেবে গতকাল ঢাকার সড়ক ভবনে একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এতে বলা হয়, একটি জাতীয় মহাসড়কের যেসব বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার, দেশের ৭০ শতাংশ জাতীয় মহাসড়কেই তা অনুপস্থিত। জাতীয় মহাসড়কগুলোতে যানবাহনের গড় গতি ঘণ্টায় প্রায় ৩০ কিলোমিটার। সড়কগুলোর বেহাল অবস্থার কারণে বাড়ছে পরিবহন ব্যয়। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে বর্তমানে বছরে ৩১ লাখ ৭২ হাজার টিইইউ কনটেইনার পরিবহন হচ্ছে জানিয়ে সেমিনারের মূল প্রবন্ধে বলা হয়, চট্টগ্রাম বন্দরের ৯৬ শতাংশ কনটেইনার এ মহাসড়ক দিয়ে পরিবহন হচ্ছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



