ছবি: সংগৃহীত
১৫ বছর আগে, ২০১০ সালের ১৭ ডিসেম্বর, তিউনিসিয়ার এক প্রত্যন্ত শহরে পুলিশি হয়রানি ও কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় হতাশ এক যুবক, ফল-শাকসবজির বিক্রেতা মোহাম্মদ বুয়াজিজি, নিজের দেহে মশাল ধরিয়ে আলোকিত করেছিলেন এক বিদ্রোহের পথ। তাঁর সেই আত্মদাহ ছিল কোনো সাধারণ প্রতিবাদ নয়; তা ছিল এক প্রতীকী অগ্নিস্ফূলিঙ্গ, যা সারা আরব বিশ্বে জ্বালিয়ে দিয়েছিল স্বৈরতন্ত্র, দুর্নীতি ও অর্থনৈতিক নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে এক অদম্য গণজাগরণের আগুন। এই "আরব বসন্ত"-এর ঢেউয়ে পরপর পতন ঘটে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় থাকা পাঁচ শক্তিশালী নেতার। আজ, সেইসব নেতাদের ভাগ্য কি হলো? কোথায় তাদের বিদায় ও পরিণতি?
১. তিউনিসিয়া: জাইন আল-আবিদিন বেন আলী – নির্বাসনে মৃত্যুর গ্লানি
ক্ষমতায়: ১৯৮৭ সাল থেকে টানা ২৩ বছর।
পতনের সূচনা: বুয়াজিজির আত্মদাহের পর দ্রুত ছড়িয়ে পড়া গণঅসন্তোষ। মাত্র ২৮ দিনের তীব্র বিক্ষোভে পর্যুদস্ত হয়ে ২০১১ সালের ১৪ জানুয়ারি সৌদি আরবে পালিয়ে যান।
পরিণতি: তিউনিসিয়ার আদালত তাঁকে অনুপস্থিতিতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিলেও সেই সাজা ভোগ করার প্রয়োজন পড়েনি। ২০১৯ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সৌদি আরবের জেদ্দায় ৮৩ বছর বয়সে নির্বাসিত অবস্থায়ই মৃত্যুবরণ করেন এই "প্রেসিডেন্ট-ফর-লাইফ" দাবিদার শাসক।
২. মিশর: হোসনি মোবারক – কারাগার থেকে মুক্তিতে মৃত্যু
ক্ষমতায়: ১৯৮১ সাল থেকে টানা ৩০ বছর।
পতনের সূচনা: ২০১১ সালের ২৫ জানুয়ারি (পুলিশ দিবস) শুরু হওয়া "১৮ দিনের বিপ্লব"। কায়রোর তাহরির স্কয়ারে লাখো মানুষের দুর্বার আন্দোলনের মুখে ২০১১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি পদত্যাগে বাধ্য হন।
পরিণতি: বিক্ষোভকারী হত্যা ও দুর্নীতির মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পান প্রথমদিকে। পরে উচ্চ আদালত রায় বাতিল করে। বিভিন্ন মামলায় কারাবরণের পর ২০১৭ সালে মুক্তি পান। শেষ জীবন কাটান কায়রোতেই এবং ২০২০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ৯১ বছর বয়সে প্রাক্তন এই প্রেসিডেন্টের মৃত্যু হয়।
৩. ইয়েমেন: আলী আবদুল্লাহ সালেহ – প্রাক্তন মিত্রের হাতে নিষ্ঠুর মৃত্যু
ক্ষমতায়: ১৯৭৮ সাল থেকে উত্তর ইয়েমেন ও ১৯৯০ থেকে একীভূত ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে মোট ৩৩ বছর।
পতনের সূচনা: ২০১১ সালের আরব বসন্তের বিক্ষোভের চাপে ২০১২ সালে ক্ষমতা হস্তান্তর চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।
পরিণতি: ক্ষমতা ছাড়ার পরও রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়াননি। হুতি বিদ্রোহীদের সঙ্গে জোট বাঁধেন, পরে আবার সৌদি জোটের সঙ্গে যোগাযোগ করলে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে হুতিদের হাতেই নিহত হন ৭৫ বছর বয়সে। "সাপের মাথায় নাচ" করা এই কূটনৈতিক শাসকের জীবনাবসান হয় সহিংসতার মধ্য দিয়ে।
৪. লিবিয়া: মুয়াম্মার গাদ্দাফি – পলাতক অবস্থায় নির্মম হত্যা
ক্ষমতায়: ১৯৬৯ সালের অভ্যুত্থানের পর থেকে টানা ৪২ বছর।
পতনের সূচনা: ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে বেনগাজিতে শুরু হওয়া বিক্ষোভ, যা ন্যাটোর হস্তক্ষেপসহ বিদেশী সহায়তাপুষ্ট গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়।
পরিণতি: ২০১১ সালের ২০ অক্টোবর নিজ জন্মস্থান সিরটে পালানোর সময় বিদ্রোহী বাহিনীর হাতে আটক হন এবং বন্দী অবস্থায় নৃশংসভাবে নিহত হন। তাঁর ৪২ বছরের অপ্রতিদ্বন্দ্বী ও রঙচঙে শাসনের চরম সহিংস ও অবর্ননীয় পরিসমাপ্তি ঘটে।
৫. সিরিয়া: বাশার আল-আসাদ – যুদ্ধ ও পতনের পর নির্বাসন
ক্ষমতায়: ২০০০ সালে পিতার উত্তরাধিকার হিসেবে ক্ষমতায় আসেন। পিতাসহ আসাদ পরিবারের শাসনকাল ৫৩ বছর (১৯৭০-২০২৪)।
পতনের সূচনা: ২০১১ সালের মার্চে দেরা প্রদেশে কিশোরদের গ্রাফিতি আঁকার ঘটনায় শুরু হয় বিক্ষোভ, যা আসাদের কঠোর দমননীতির মুখে ভয়াবহ গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়। ২০২৪ সালের ৮ ডিসেম্বর হায়াত তাহরির আল-শাম (HTS) নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহীদের দামেস্ক অভিযানের মুখে রাজধানী দখল হয়ে যায়।
পরিণতি: সেনাবাহিনী ভেঙে পড়লে, ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে, পরিবার ও ঘনিষ্ঠ অনুচরসহ রাশিয়ায় আশ্রয় নেন। বর্তমানে মস্কোতেই নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছেন, যার মধ্য দিয়ে পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা আসাদ বংশের শাসনের চূড়ান্ত পরিসমাপ্তি ঘটে।
ইতিহাসের নির্মম ফিরিস্তি
আরব বসন্তের এই পাঁচ শাসকের গল্প শুধু ব্যক্তির পতনের গল্প নয়; এটি ক্ষমতার দর্পণ, জনরোষের শক্তি এবং ইতিহাসের নির্মম পালাবদলের গল্প। কেউ মরেছেন নির্বাসনের গ্লানিতে, কেউ জেল-মুক্তির পর স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেছেন, কেউবা প্রাক্তন মিত্র বা বিদ্রোহীর হাতে খুন হয়েছেন। সর্বশেষ বাশার আল-আসাদের পতন ও নির্বাসন যেন এই অধ্যায়ের একটি সাময়িক পরিসমাপ্তির ইঙ্গিত দেয়। মোহাম্মদ বুয়াজিজির মশাল থেকে সূচিত সেই আগুন, একের পর এক সিংহাসন দগ্ধ করেছে, রচনা করেছে নতুন ইতিহাস, কিন্তু অনেক দেশের জন্য তা স্থায়ী স্থিতিশীলতা ও গণতন্ত্রের পথও মসৃণ করে দেয়নি। আরব বসন্তের চেতনা ও তার ফলাফলের এই জটিল বয়ানই আজও গবেষক ও ইতিহাসবিদদের জন্য একটি গভীর উপলব্ধির বিষয় হয়ে রয়েছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



