ছবি: সংগৃহীত
পিরোজপুরে দীর্ঘ ১৩ বছর ধরে চালানো এক সুপরিকল্পিত আর্থিক প্রতারণা ও টাকা পাচারের কেলেঙ্কারির বিস্তারিত তদন্ত শেষে অভিযোগপত্র দাখিল করেছে বাংলাদেশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। ‘এহসান মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড’ ও ‘এহসান রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড বিল্ডার্স লিমিটেড’ নামের দুই প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ও তাঁর স্ত্রীসহ মোট সাত ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান দুইটির বিরুদ্ধে ২০০৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সময়ে প্রতারণার মাধ্যমে সংগৃহীত ১০১ কোটি ৪৫ লাখ ৯৪ হাজার ২৩৮ টাকা পাচারের অভিযোগ আনা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (১১ ডিসেম্বর) সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (মিডিয়া) জসীম উদ্দিন খান নিশ্চিত করেন যে, পিরোজপুর সদর থানায় দায়ের করা মামলার তদন্ত শেষে বিস্তারিত অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে। অভিযুক্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে প্রাথমিক তদন্তে অর্থ পাচার ও প্রতারণার অভিযোগ দৃঢ়ভাবে প্রমাণিত হয়েছে বলে সিআইডি সূত্রে জানা গেছে।
সিআইডির তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৮ সাল থেকে রাগীব আহসান (৪০) ও তাঁর স্ত্রী সালমা আহসান (৩২) প্রতিষ্ঠান দুটিকে বৈধ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মুখোশ পরিয়ে দীর্ঘমেয়াদি এক প্রতারণার জাল বিস্তার করেন। তারা স্থানীয় জনগণ, ব্যবসায়ী এবং প্রবাসী বাংলাদেশীদের পরিবারের সদস্যদের কাছে সরাসরি বাড়ি-বাড়ি গিয়ে, স্থানীয় বিভিন্ন সভা-সমাবেশে অংশ নিয়ে এবং একঝাঁক এজেন্টের মাধ্যমে উচ্চ মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে বিনিয়োগের নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করেন। তাদের প্রচারণায় আকৃষ্ট হয়ে পিরোজপুর, বরিশাল ও আশেপাশের জেলার এক হাজারেরও বেশি মানুষ জীবনভর সঞ্চয়, জমি বিক্রয়ের অর্থ, এমনকি বিদেশ থেকে প্রেরিত রেমিট্যান্স পর্যন্ত তাদের হাতে তুলে দেন।
তদন্তে আরও উঠে এসেছে, এই চক্র স্থানীয় মসজিদ, স্কুল ও মাদ্রাসার তহবিল থেকেও টাকা সংগ্রহ করেছিল উচ্চ মুনাফার লোভ দেখিয়ে। প্রতিষ্ঠান দুইটির কার্যক্রম ছিল অত্যন্ত সুপরিকল্পিত ও বিশ্বাসযোগ্য। তারা নিয়মিত কিছু মুনাফা বা লভ্যাংশ দিয়েও বিনিয়োগকারীদের আস্থা ধরে রেখেছিল দীর্ঘদিন, যাতে আরও বেশি মানুষ তাদের জালে আটকা পড়ে।
সিআইডির তদন্তকারী কর্মকর্তারা জানান, সংগৃহীত ১০১ কোটি টাকার বেশি অর্থ পরস্পর যোগসাজশে বিভিন্ন ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার ও আত্মসাৎ করা হয়েছে। টাকা পাচারের এই কার্যক্রমে সরাসরি জড়িত ছিলেন অভিযুক্ত অন্যান্যরা। তারা হলেন: মো. আবুল বাশার খান (৩৫), খায়রুল ইসলাম (৩৫), শামীম হাসান (৩৭), মো. মাহমুদুল হাসান (৩১) ও মো. নাজমুল ইসলাম। এরা সকলেই অভিযুক্ত দম্পতির নিকট আত্মীয় বা ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন এবং প্রতিষ্ঠান দুইটির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত থেকে অর্থ সংগ্রহ ও স্থানান্তরের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন।
তদন্তে প্রমাণ মিলেছে, সংগৃহীত অর্থ তারা স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি ক্রয়, ব্যক্তিগত বিলাসবহুল জীবনযাপন এবং আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে বণ্টনের মাধ্যমে পাচার করেছে। প্রতিষ্ঠান দুইটির ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও আর্থিক লেনদেনের উপর নিবিড় পর্যবেক্ষণ করে সিআইডি অর্থের গতিপথ শনাক্ত করতে সক্ষম হয়।
এই প্রতারণার শিকার হয়ে পিরোজপুরসহ বিভিন্ন এলাকার শত শত মানুষ আর্থিকভাবে সর্বস্বান্ত হন। অনেক পরিবারের জীবনযাত্রা ও ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে। এই ঘটনায় ইতোপূর্বে পিরোজপুর সদর থানাসহ বিভিন্ন থানায় ভুক্তভোগীরা প্রায় শতাধিক মামলা দায়ের করেছিলেন। সিআইডি সেই সব মামলা এবং নতুন করে পাওয়া তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে পিরোজপুর সদর থানায় নিজেদের মামলা দায়ের করে এবং গভীর তদন্ত শুরু করে।
প্রায় ১০০টি মামলার দলিল ও তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে সিআইডি অভিযোগগুলোর সত্যতা নিশ্চিত হয়। দীর্ঘ ও জটিল তদন্ত প্রক্রিয়া শেষে আজ অভিযোগপত্র দাখিলের মাধ্যমে এই মামলাটি বিচারের পথে এগোচ্ছে।
অভিযোগপত্র দাখিলের পর বিচারার্থে সকল অভিযুক্তকে সোপর্দ করা হয়েছে। বর্তমানে তারা হাজতবাসী রয়েছেন। আদালতের প্রক্রিয়া অনুসরণ করে এখন অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক বিচারকার্য শুরু হবে। সিআইডির পক্ষ থেকে আইনগত সকল প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানানো হয়েছে।
সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার জসীম উদ্দিন খান বলেন, "এই মামলাটি আর্থিক প্রতারণা ও অর্থ পাচারের একটি জটিল নেটওয়ার্ক উন্মোচন করেছে। আমরা প্রমাণ সহকারে আদালতে সবকিছু উপস্থাপন করেছি। আশা করি, দ্রুত বিচার নিশ্চিত হয়ে ভুক্তভোগীদের কিছুটা ন্যায়বিচার মিলবে।"
এ ঘটনায় স্থানীয় জনগণ ও সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে দ্রুত বিচার নিষ্পত্তি ও ভুক্তভোগীদের ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করার দাবি উঠেছে। সিআইডির এই তদন্ত ও ব্যবস্থা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নামে চলা অন্যান্য সম্ভাব্য প্রতারণামূলক চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের একটি স্পষ্ট বার্তা বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



