
ছবি: সংগৃহীত
ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। শনিবার (১৮ অক্টোবর) দুপুর ২টা ১৫ মিনিটে হঠাৎ করে লাগা এ আগুন মুহূর্তের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে কার্গো ভিলেজের একাধিক অংশে। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ইতোমধ্যে ফায়ার সার্ভিস, বিমানবাহিনী ও বিমানবন্দরের নিজস্ব অগ্নিনির্বাপক ইউনিটের সদস্যরা যৌথভাবে কাজ শুরু করেছে। তবে বিকেল পর্যন্ত আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এই আগুন নিয়ন্ত্রণে ঘটনাস্থলে পৌঁছেছে ফায়ার সার্ভিসের ২৮টি ইউনিট।
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) সহকারী পরিচালক ও জনসংযোগ কর্মকর্তা মোহাম্মদ কাউছার মাহমুদ গণমাধ্যমকে জানান, দুপুর ২টা ১৫ মিনিটের দিকে বিমানবন্দরের কার্গো এলাকার একটি অংশে হঠাৎ করে আগুনের সূত্রপাত হয়। খবর পেয়ে দ্রুত বিমানবন্দরের ফায়ার ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা শুরু করে। একইসঙ্গে বিমানবাহিনীর অগ্নিনির্বাপক দলও উদ্ধার অভিযানে যোগ দেয়। আগুন ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় কার্গো ভিলেজ ও এর আশপাশের অংশ থেকে কর্মচারী ও শ্রমিকদের দ্রুত সরিয়ে নেওয়া হয়।
তিনি আরও বলেন, “অগ্নিকাণ্ডের কারণে নিরাপত্তাজনিত বিবেচনায় বিমানবন্দরের ফ্লাইট অপারেশন সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে। যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই এখন আমাদের প্রধান লক্ষ্য। সবাইকে অনুরোধ করা হচ্ছে, কেউ যেন আতঙ্কিত না হন এবং কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা মেনে চলেন।”
ফায়ার সার্ভিসের কন্ট্রোল রুমের ডিউটি অফিসার রাফি আল ফারুক জানান, দুপুর ২টা ৩০ মিনিটে বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে আগুন লাগার খবর তারা পান। খবর পাওয়ার মাত্র চার মিনিট পর, অর্থাৎ ২টা ৩৪ মিনিটে প্রথমে চারটি ইউনিট ঘটনাস্থলের উদ্দেশে রওনা দেয়। পরে আগুনের মাত্রা বেড়ে গেলে আরও নয়টি ইউনিটকে সহায়তার জন্য পাঠানো হয়। “আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। এখন পর্যন্ত হতাহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি,” বলেন রাফি আল ফারুক।
বিমানবন্দরের ভেতরে অবস্থানরত প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, কার্গো ভিলেজের কুরিয়ার গোডাউনের একটি অংশ থেকেই আগুনের সূত্রপাত হয়। অল্প সময়ের মধ্যেই আগুন পাশের গুদামঘরগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে এবং তীব্র ধোঁয়ায় চারদিক অন্ধকার হয়ে যায়। অনেকে নিজেদের নিরাপত্তার জন্য দ্রুত বাইরে বের হয়ে আসেন।
প্রত্যক্ষদর্শী শাহীনুর রহমান নামে এক লজিস্টিক কর্মী বলেন, “প্রথমে হালকা ধোঁয়া বের হতে দেখি। কিছু সময়ের মধ্যে বড় শব্দ হয় এবং আগুন ছড়িয়ে পড়ে। আমরা সবাই দৌড়ে বের হয়ে যাই। ফায়ার সার্ভিস এসে দ্রুত কাজ শুরু করে, কিন্তু আগুন অনেক বড় আকার ধারণ করেছে।”
এদিকে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান এএফএম ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল–এর কর্মকর্তা মাহবুবুল আলম নিয়ন জানান, তাদের আমদানি করা পণ্য কয়েক ঘণ্টা আগেই কার্গো ভিলেজে রাখা হয়েছিল। “দুপুর ১২টার দিকে আমরা মালামাল ডেলিভারি দিই। এখন সবকিছুই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কোটি টাকার ক্ষতি হলো আমাদের,” তিনি বলেন।
অগ্নিকাণ্ডের কারণ সম্পর্কে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট বা কোনো যান্ত্রিক ত্রুটি থেকে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে। বিষয়টি তদন্তে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি ফায়ার সার্ভিসের একটি বিশেষ টিম ঘটনাস্থলে কাজ করছে।
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বিমানবন্দরের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক উভয় ফ্লাইট সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে। এ কারণে দুপুরের পর থেকে কয়েকটি ফ্লাইটের যাত্রীদের অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে টার্মিনাল ভবনের ভেতরেই। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ যাত্রীদের আশ্বস্ত করেছে যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসলেই ফ্লাইট অপারেশন পুনরায় চালু করা হবে।
আগুন লাগার সময় বিমানবন্দরের আশপাশের এলাকায় তীব্র ধোঁয়া দেখা যায়, যা উত্তরার কিছু অংশ থেকেও স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান ছিল। স্থানীয়দের অনেকেই জানান, আগুনের তীব্রতা এত বেশি যে দূর থেকেও তাপ অনুভূত হচ্ছিল।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল পর্যন্ত আগুন নিয়ন্ত্রণে না আসায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিভিন্ন কুরিয়ার কোম্পানি, এয়ারলাইনসের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং অফিস এবং বেসরকারি আমদানি-রপ্তানি প্রতিষ্ঠানের পণ্য এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানা গেছে।
আগুন নিয়ন্ত্রণে এয়ারপোর্ট ফায়ার ইউনিটের পাশাপাশি বাংলাদেশ বিমানবাহিনী, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন), এয়ারপোর্ট সিকিউরিটি ইউনিট, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির উদ্ধার দল এবং বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা মাঠে রয়েছেন। উদ্ধার তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।
এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ এলাকায় প্রবেশাধিকার সীমিত করে দেওয়া হয়েছে, যাতে উদ্ধার ও নির্বাপণ কার্যক্রম নির্বিঘ্নে চলতে পারে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আগুন নিয়ন্ত্রণে এলে ক্ষয়ক্ষতির সঠিক পরিমাণ ও আগুনের উৎস নির্ধারণে একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে।
বিমানবন্দরের ইতিহাসে এটি সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম বড় অগ্নিকাণ্ড বলে মন্তব্য করেছেন একজন কর্মকর্তা, যিনি নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক। তিনি বলেন, “এই অগ্নিকাণ্ড শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, বিমান নিরাপত্তা ও কার্গো ব্যবস্থাপনায়ও বড় ধাক্কা হতে পারে।”
বিকেল পর্যন্ত শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজের আকাশে ধোঁয়ার কুণ্ডলী ঘুরপাক খেতে দেখা গেছে। আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে ফায়ার সার্ভিস ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।
বাংলাবার্তা/এসজে