
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের টেলিকম খাতে আবারও অস্থিরতা দেখা দিয়েছে আন্তর্জাতিক গেটওয়ে অপারেটরস ফোরাম (আইওএফ) বাতিলের সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) সম্প্রতি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাতে ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে (আইজিডব্লিউ) খাতের প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ ঝুঁকিতে পড়ে গেছে। বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের মতে, এই সিদ্ধান্ত একদিকে যেমন আইনি প্রক্রিয়া ও ন্যায্যতার পরিপন্থী, তেমনি এর ফলে অতীতে দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের দায়মুক্তি দেওয়া হচ্ছে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে।
২০১২ সালে শেখ হাসিনা সরকারের সময় ইন্টারন্যাশনাল কল টার্মিনেশন সেক্টরে এক ভয়াবহ অরাজকতা দেখা দেয়। অভিযোগ রয়েছে, সে সময় ছয়টি আইজিডব্লিউ কোম্পানির একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট প্রায় ৯২১ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে। এসব কোম্পানির অন্যতম মালিক ছিলেন তৎকালীন সরকারের উপদেষ্টা ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ী সালমান এফ রহমান। কল টার্মিনেশন খাতে অবৈধ ভিওআইপি (VoIP) বাণিজ্যের মাধ্যমে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারায়।
পরিস্থিতি সামাল দিতে এবং আন্তর্জাতিক কল টার্মিনেশন খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে ২০১৫ সালে গঠিত হয় আন্তর্জাতিক গেটওয়ে অপারেটরস ফোরাম (আইওএফ)। এরপর থেকেই ধীরে ধীরে এ খাতে শৃঙ্খলা ফিরে আসে, লুটপাট কমে যায় এবং সরকারের রাজস্ব আদায়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটে।
আইওএফ প্রেসিডেন্ট আসিফ সিরাজ রব্বানীর তথ্য অনুযায়ী, আইওএফ গঠনের পর থেকে এই ফোরামের মাধ্যমে সরকারকে মোট ৫,৬০৭ কোটির বেশি টাকা রাজস্ব দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ৪,৩৪২ কোটি টাকার রাজস্ব অংশীদারিত্ব, ৬৩৫ কোটি টাকার লাইসেন্স ফি এবং ৬৩০ কোটি টাকার ভ্যাট ও অগ্রিম আয়কর। এই পরিসংখ্যান প্রমাণ করে যে, আইওএফ বাতিল করলে শুধু বিনিয়োগ ঝুঁকির মুখে পড়বে না, বরং সরকারের রাজস্ব আয়ও বড় ধরনের ধাক্কা খাবে।
সংশ্লিষ্ট মহলের অভিযোগ, আইওএফ বাতিলের মাধ্যমে মূলত ২০১২ সালের লুটপাটে জড়িত আইজিডব্লিউ মালিক ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের রক্ষা করাই উদ্দেশ্য। বিশেষ করে, সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো কম্পিউটারসের সঙ্গে বিটিআরসির চুক্তি ও পরবর্তী সময়ে এমডিএস (মার্কেট ডেভেলপমেন্ট এক্সপেন্সেস) ফান্ডের মাধ্যমে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা স্থানান্তরের ঘটনায় গভীর অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। আইওএফ দাবি করেছে, এই ফান্ডের বেশিরভাগ অর্থের ব্যবহার এখনো অজানা এবং রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে তা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে।
আইওএফ প্রেসিডেন্ট আসিফ রব্বানী বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর দায়িত্ব নিয়ে তিনিই এমডিএস ফান্ড বাতিল করেন। তিনি প্রশ্ন তোলেন, “ফ্যাসিস্ট সরকারের লোকদের দুর্নীতির দায় বর্তমান সক্রিয় আইওএফ নেতৃবৃন্দ কেন বহন করবে?”
আইওএফ নেতারা বলছেন, বিটিআরসি কোনো ধরনের আলোচনার সুযোগ না দিয়েই চুক্তি বাতিল করেছে। আত্মপক্ষ সমর্থনের ন্যূনতম সুযোগ পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। এমনকি একটি শোকজ নোটিশ পাঠানোরও প্রয়োজন মনে করা হয়নি। আইওএফ এটিকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও বিনিয়োগবিরোধী সিদ্ধান্ত হিসেবে অভিহিত করেছে।
আইওএফের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সংস্থা সবসময় বিটিআরসির নির্দেশনা মেনেই কাজ করেছে। প্রতিদিন ও মাসিক ভিত্তিতে আইজিডব্লিউ ও আইওএস অনুযায়ী ট্রাফিক রিপোর্ট ও আর্থিক তথ্য নিয়মিত জমা দেওয়া হয়েছে। এমনকি বিটিআরসির সদর দপ্তরে নিজ খরচে রিয়েল টাইম কল মনিটরিং সিস্টেম স্থাপন করা হয়েছে। এত কিছু করার পরও কোনো ধরনের যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা ছাড়াই চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা প্রশ্নবিদ্ধ।
বিটিআরসির অভিযোগ অনুযায়ী, কল বিতরণে অসমতা, বকেয়া রাজস্ব এবং চুক্তি পরিবর্তনই ছিল আইওএফ বাতিলের কারণ। আইওএফ এসব অভিযোগের জবাবে বলেছে, কল বিতরণে যে অসমতা দেখা গেছে, তা প্রযুক্তিগত বাধার ফল, যার মধ্যে রয়েছে খাজা টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ড ও ফ্যাসিস্ট বিরোধী আন্দোলনের সময় সরকারি নির্দেশে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ থাকা। এতে সার্ভিস বিঘ্নিত হলেও, বিষয়গুলো বিটিআরসিকে অবহিত করা হয়েছিল।
বকেয়া রাজস্ব নিয়েও আইওএফ বলছে, সব আইজিডব্লিউ অপারেটর বিটিআরসিতে ব্যাংক গ্যারান্টি জমা রেখেছে। চাইলে বিটিআরসি এখান থেকেই রাজস্ব আদায় করতে পারত। এমনকি দুটি অপারেটরের অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করার কারণে সামান্য অর্থ বকেয়া পড়লেও এখন তা সচল এবং পরিশোধে প্রস্তুত রয়েছে।
চুক্তি পরিবর্তনের প্রসঙ্গেও আইওএফ সাফ জানায়, বিটিআরসির অনুমোদন ছাড়া কোনো পরিবর্তন করা হয়নি। বরং বিটিআরসি নিজেই ২০২৪ সালের ৩ ডিসেম্বর তিনটি ধারা পরিবর্তনের নির্দেশ দেয়। তার মধ্যে একটি ধারা আইওএফ গ্রহণ করে, বাকি দুইটির বিকল্প প্রস্তাব দিয়ে ৩০ জানুয়ারি ২০২৫ সালে অনুমোদনের জন্য জমা দেয়। তবে এখনো বিটিআরসি কোনো উত্তর দেয়নি।
আইওএফ বাতিলের ফলে সবচেয়ে বড় যে ক্ষতির মুখোমুখি হতে পারে বাংলাদেশ, তা হলো বিনিয়োগের পরিবেশে নেতিবাচক বার্তা। আইওএফ বলছে, বর্তমানে যে ২৩টি আইজিডব্লিউ কোম্পানি সক্রিয় রয়েছে, তাদের সম্মিলিত বিনিয়োগ প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। এ সিদ্ধান্তের ফলে এসব কোম্পানি অনিশ্চয়তায় পড়বে। বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমবে, বিদেশি বিনিয়োগও বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
আইওএফ সভাপতি স্পষ্ট করে বলেন, "আমরা নিয়ম মেনে ব্যবসা করতে চাই। কিন্তু যারা অতীতে টেলিকম খাত লুট করেছে, তাদের দায়ভার আমরা নিতে পারি না। তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত হোক, কিন্তু আমাদের মতো নিয়মিত করদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে কেন শাস্তি পেতে হবে?"
বিটিআরসি চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল এমদাদ উল বারী এ বিষয়ে বলেছেন, "বিষয়টি নিয়ে আমরা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলবো। যদি কোনো পক্ষের আপত্তি থাকে, তা মীমাংসার সুযোগ রয়েছে।" তবে আইওএফ নেতারা বলছেন, এই বক্তব্য সান্ত্বনা ছাড়া আর কিছু নয়, কারণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে কোনো আলোচনা হয়নি, এখন হওয়ার সম্ভাবনাও ক্ষীণ।
আইওএফ বাতিলের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের টেলিকম খাতে শুধুই একটি সংগঠনের বিলুপ্তি নয়, বরং এটি একটি বৃহৎ বিনিয়োগ ও রাজস্ব আয়ের ঝুঁকির নামান্তর। অতীতের লুটপাটকারীদের রক্ষা করতে গিয়ে বর্তমানে সক্রিয় ও সুশৃঙ্খল প্রতিষ্ঠানগুলোর ভবিষ্যৎ বিপন্ন করা হলে তা দেশের ডিজিটাল অগ্রগতির জন্য এক বড় ধাক্কা হবে। এখন সময় হলো, সরকারের উচিত বিটিআরসির সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সঙ্গে আলাপ করে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছানো, যাতে বিনিয়োগ ও সুশাসন—দুইই বজায় থাকে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ