ছবি: সংগৃহীত
বলিউডের ‘বাদশাহ’ শাহরুখ খান—যার প্রতিটি সিনেমা মানেই যেন নতুন এক অধ্যায়, নতুন এক ইতিহাস। এবার সেই ইতিহাস লিখতে চলেছেন তিনি আরও একবার, আসন্ন চলচ্চিত্র ‘কিং’–এর মাধ্যমে। বহুদিন ধরেই গুঞ্জন চলছিল, শাহরুখ এবার এমন এক সিনেমা নিয়ে ফিরছেন, যা ভারতীয় সিনেমার বাজেট, অ্যাকশন ও প্রযুক্তিগত পরিসর—সব কিছুতেই নতুন রেকর্ড তৈরি করবে। আর সেই গুঞ্জন এখন ক্রমেই বাস্তবে রূপ নিচ্ছে।
শাহরুখ খানের জন্মদিনে (২ নভেম্বর) আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা আসে ‘কিং’-এর। মাত্র সোয়া মিনিটের একটি টিজার প্রকাশের পর থেকেই যেন সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় বয়ে যায়। বাদশাহর গ্ল্যামার, রহস্যময় উপস্থিতি, আর সেই সঙ্গে বিদ্যুতের মতো দ্রুত গতির অ্যাকশন দৃশ্য—সব মিলিয়ে ভক্তদের মনে তৈরি হয় এক অন্য রকম উত্তেজনা।
সিনেমার নির্মাতা ও প্রযোজনা সংস্থা রেড চিলিজ এন্টারটেইনমেন্ট এখনও পূর্ণাঙ্গ ঘোষণা না দিলেও টিজারটি থেকেই পরিষ্কার—এটি শুধু একটি সিনেমা নয়, বরং শাহরুখের ক্যারিয়ারের এক নতুন মাইলফলক হতে যাচ্ছে।
গত কয়েক দিন ধরে বলিউডের সর্বত্র আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে ‘কিং’-এর বাজেট। ভারতীয় বিনোদন সংবাদমাধ্যম বলিউড হাঙ্গামা জানিয়েছে, ছবিটির প্রাথমিক বাজেট নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৫০ কোটি রুপি। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যখন নির্মাতারা আন্তর্জাতিক মানের অ্যাকশন, ভিএফএক্স ও লোকেশন যুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেন, তখন বাজেট বাড়তে বাড়তে পৌঁছেছে প্রায় ৩৫০ কোটি রুপিতে।
এখানেই শেষ নয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই হিসাবের মধ্যে এখনও শাহরুখ খানের পারিশ্রমিক, বিপণন, প্রচার ও আন্তর্জাতিক রিলিজ সংক্রান্ত ব্যয় যুক্ত করা হয়নি। ফলে ধারণা করা হচ্ছে, চূড়ান্ত বাজেট ৫০০ কোটি রুপি ছাড়িয়ে যেতে পারে, যা বলিউড ইতিহাসে অন্যতম ব্যয়বহুল প্রজেক্ট হিসেবে রেকর্ড করবে।
আশ্চর্যের বিষয়, ‘কিং’-এর ধারণা প্রথমে ছিল একদম ভিন্ন। ছবিটি শুরুতে পরিকল্পনা করেছিলেন পরিচালক সুজয় ঘোষ, একটি মাঝারি বাজেটের থ্রিলার হিসেবে। তবে পরবর্তীতে বলিউডের জনপ্রিয় অ্যাকশন চলচ্চিত্র নির্মাতা সিদ্ধার্থ আনন্দ (যিনি ‘পাঠান’ ও ‘ওয়ার’-এর পরিচালক) প্রকল্পটির দায়িত্ব নেন।
সিদ্ধার্থের সঙ্গে বসে শাহরুখ খান সম্পূর্ণভাবে গল্প, চরিত্র এবং সিনেমার কনসেপ্ট পুনর্গঠন করেন। তাদের লক্ষ্য একটাই—ভারতীয় সিনেমার দর্শকদের এমন এক অ্যাকশন অভিজ্ঞতা উপহার দেওয়া, “যা আগে কখনো বলিউডে দেখা যায়নি।”
‘কিং’-এ থাকবে ছয়টি বিশাল অ্যাকশন সিকোয়েন্স, যার মধ্যে তিনটি শ্যুট করা হবে বাস্তব লোকেশনে—ইউরোপ, দুবাই এবং মুম্বাইয়ে, আর বাকি তিনটি দৃশ্য বিশেষভাবে নির্মিত সেটে। এসব সেট তৈরি করতে ব্যয় হচ্ছে বিপুল অর্থ।
চলচ্চিত্রের সূত্র জানিয়েছে, শাহরুখ খানের ইনট্রোডাকশন সিন বা প্রথম উপস্থিতির দৃশ্যেই ব্যয় হচ্ছে কয়েক কোটি রুপি। এটি এমনভাবে পরিকল্পনা করা হয়েছে যেন দর্শকরা সিনেমা শুরু হওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই এক নতুন রূপে বাদশাহকে দেখতে পান।
ভিএফএক্সের ক্ষেত্রে মেট্রিক্স স্টাইল ও মার্ভেল ইউনিভার্সের প্রভাব থাকলেও, এতে ভারতীয় রঙ ও বীরত্বের ছোঁয়া থাকবে বলে জানিয়েছে প্রযোজনা টিম। ভিজ্যুয়াল এফেক্টস পরিচালনা করছেন হলিউডের একাধিক অস্কারজয়ী টেকনিশিয়ান দল।
‘কিং’ প্রযোজনা করছেন শাহরুখ খানের স্ত্রী গৌরী খান এবং সিদ্ধার্থ আনন্দের স্ত্রী মমতা আনন্দ, যৌথভাবে রেড চিলিজ এন্টারটেইনমেন্ট ও মার্কারি প্রোডাকশনস ব্যানারে। শাহরুখ নিজেও ছবিটির অন্যতম সহপ্রযোজক হিসেবে যুক্ত আছেন।
অভিনয়শিল্পীদের তালিকাটিও বিস্ময়করভাবে তারকাখচিত। শাহরুখ খানের সঙ্গে প্রথমবারের মতো বড় পর্দায় অভিনয় করছেন তাঁর মেয়ে সুহানা খান। এছাড়া রয়েছেন বলিউডের শীর্ষ অভিনেত্রীরা দীপিকা পাডুকোন ও রানী মুখার্জি, পাশাপাশি কিংবদন্তি অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন, অভিষেক বচ্চন, আরশাদ ওয়ারসি, রাঘব জুয়েল প্রমুখ।
চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর দাবি, শাহরুখ চান তাঁর মেয়ের বড় পর্দার আত্মপ্রকাশটি হোক “বোল্ড, গ্লোবাল এবং ইউনিক।” তাই সিনেমাটিতে সুহানার চরিত্রটি কেবল সহনায়িকা নয়, বরং গল্পের কেন্দ্রীয় আবেগের মূল চালিকা শক্তি হিসেবে সাজানো হয়েছে।
‘কিং’ কেবল একটি অ্যাকশন সিনেমা নয়; এতে রয়েছে গভীর মানবিক গল্প, পারিবারিক সম্পর্ক, বিশ্বাসঘাতকতা ও আত্মপরিচয়ের সংকট। শাহরুখের চরিত্রটি এক রহস্যময় অতীতবাহী আন্ডারকভার এজেন্ট, যিনি বছর পর আবার মিশনে নামেন—একই সঙ্গে নিজের হারিয়ে যাওয়া পরিবারের সন্ধানেও বের হন।
সিনেমার সংগীত পরিচালনা করছেন প্রিতম, যিনি এর আগে ‘পাঠান’, ‘ওয়ার’ ও ‘বাচ্চন পাণ্ডে’-র মতো ছবিতে হিট গান উপহার দিয়েছেন। ইতিমধ্যেই জানা গেছে, ছবির জন্য তিনটি গান ইউরোপ ও মরক্কোতে চিত্রায়িত হবে।
‘কিং’ মুক্তির সম্ভাব্য সময় ২০২৬ সাল, এবং এটি একযোগে হিন্দি, তামিল, তেলুগু ও ইংরেজি ভাষায় মুক্তি পাবে। এছাড়া চলচ্চিত্রটি আন্তর্জাতিক বাজারেও বড় পরিসরে মুক্তির পরিকল্পনা রয়েছে—বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে, যেখানে শাহরুখের বিপুল ফ্যানবেস রয়েছে।
বলিউড বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ‘কিং’ সফল হলে এটি শুধু শাহরুখের ক্যারিয়ারের নয়, বরং সমগ্র ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্পের জন্যও এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।
চলচ্চিত্র বিশ্লেষক তারান আদর্শ বলেছেন, “সিদ্ধার্থ আনন্দ ও শাহরুখ খানের জুটি মানেই এখন ‘হাই ভোল্টেজ এন্টারটেইনমেন্ট’। ‘পাঠান’-এর পর তারা বলিউডে আবারও এমন কিছু আনতে যাচ্ছেন, যা বক্স অফিসে নতুন মানদণ্ড তৈরি করবে।”
অন্যদিকে সমালোচক অনুপমা চোপড়া বলেন, “‘কিং’ কেবল একটি সিনেমা নয়, এটি শাহরুখ খানের উত্তরাধিকার প্রজন্মান্তরে পৌঁছে দেওয়ার প্রচেষ্টা। সুহানার অংশগ্রহণ এই চলচ্চিত্রকে আরও বিশেষ করে তুলেছে।”
শাহরুখ খান যখনই বড় পর্দায় ফেরেন, তখনই যেন বলিউডে নতুন প্রাণ ফিরে আসে। ‘পাঠান’ ও ‘জওয়ান’-এর পর ‘কিং’ হতে যাচ্ছে সেই ধারাবাহিকতার আরও এক উচ্চতম অধ্যায়। রেকর্ড বাজেট, আন্তর্জাতিক মানের প্রযুক্তি, শক্তিশালী গল্প ও পারিবারিক সংযোগ—সব মিলিয়ে ‘কিং’ কেবল একটি সিনেমা নয়, এটি হতে যাচ্ছে ভারতীয় চলচ্চিত্র ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায়, যেখানে বাদশাহ নিজেই তাঁর রাজত্ব নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করবেন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



