ছবি: সংগৃহীত
বিশ্বব্যাপী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের রাজত্বে নেতৃত্ব দিচ্ছে মার্কিন প্রযুক্তি জায়ান্ট মেটা প্ল্যাটফর্মস ইনকর্পোরেটেড (Meta Platforms Inc.)। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপের মতো জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্মের মালিক এই প্রতিষ্ঠানটি বিজ্ঞাপনভিত্তিক আয়ের ওপর নির্ভরশীল। তবে সম্প্রতি আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা রয়টার্স প্রকাশিত এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে—মেটার মোট আয়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এসেছে অবৈধ ও প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপন থেকে।
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মেটার নিজস্ব আর্থিক বিশ্লেষণ অনুযায়ী ২০২৪ সালে তাদের বার্ষিক আয়ের প্রায় ১০ শতাংশ—অর্থাৎ প্রায় ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার—এসেছে ভুয়া, বিভ্রান্তিকর ও অবৈধ বিজ্ঞাপন থেকে। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটির একটি বড় অংশের রাজস্বই এসেছে এমন উৎস থেকে, যা সরাসরি আইন, নৈতিকতা ও ব্যবহারকারীর সুরক্ষাবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
রয়টার্স তাদের হাতে পাওয়া মেটার অভ্যন্তরীণ নথি উদ্ধৃত করে জানিয়েছে, গত তিন বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটি অবৈধ জুয়া, ভুয়া বিনিয়োগ প্রকল্প, ক্রিপ্টো প্রতারণা, ওষুধ ও স্বাস্থ্যপণ্য সংক্রান্ত নিষিদ্ধ বিজ্ঞাপন ঠেকাতে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। অনেক সময় এসব বিজ্ঞাপনে এমন পণ্য বা সেবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, যা আদৌ বাস্তবে অস্তিত্বই নেই।
এই বিজ্ঞাপনগুলোর মাধ্যমে কোটি কোটি সাধারণ ব্যবহারকারী ভুয়া ওয়েবসাইটে অর্থ বিনিয়োগ, লাভের প্রতিশ্রুতিতে অ্যাকাউন্ট খোলা, কিংবা নিষিদ্ধ স্বাস্থ্যপণ্য ক্রয়ে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। ফলে ব্যবহারকারীরা আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি তথ্য-নিরাপত্তা ঝুঁকিতেও পড়ছেন।
প্রতিবেদন বলছে, মেটার স্বয়ংক্রিয় বিজ্ঞাপন পর্যালোচনা ব্যবস্থা অনেক ক্ষেত্রেই এমন বিজ্ঞাপন শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়। বরং কোম্পানি তখনই কোনো বিজ্ঞাপনদাতার অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে, যখন তারা অন্তত ৯৫ শতাংশ নিশ্চিত হয় যে বিজ্ঞাপনটি প্রতারণামূলক। এই সীমা পর্যন্ত অপেক্ষা করার মানে হলো—অনেক প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপন দীর্ঘ সময় ধরে সক্রিয় থাকে এবং সেই সময় মেটা বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করে।
অভ্যন্তরীণ নথি অনুযায়ী, সন্দেহভাজন বিজ্ঞাপনদাতাদের ক্ষেত্রে মেটা প্রথমে অতিরিক্ত ফি বা জরিমানা আদায় করে, যার উদ্দেশ্য দেখানো হয়—“ভবিষ্যতে যেন তারা এ ধরনের বিজ্ঞাপন না দেয়।” কিন্তু বাস্তবে এসব বিজ্ঞাপনদাতা নতুন নামে, নতুন পেমেন্ট পদ্ধতি ব্যবহার করে আবারও বিজ্ঞাপন দিতে সক্ষম হন।
এভাবে কোম্পানি একদিকে প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপন বন্ধ না করে আয় করে, অন্যদিকে অতিরিক্ত ফি হিসেবে আরও অর্থ আদায় করে—ফলে মেটার রাজস্ব ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পায়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, অনেক সময় মেটা কর্মীদের ওপর এমন অভ্যন্তরীণ চাপ থাকে যে তারা বিজ্ঞাপনদাতাদের ব্লক না করে রাজস্ব হারাতে না দেন। কারণ, বিজ্ঞাপনদাতাদের কার্যক্রম বন্ধ হলে কোম্পানির ত্রৈমাসিক আয়ে সরাসরি প্রভাব পড়ে।
বিতর্ক ছড়িয়ে পড়ার পর মেটার মুখপাত্র অ্যান্ডি স্টোন রয়টার্সকে পাঠানো এক বিবৃতিতে দাবি করেন, প্রতিবেদনে মেটার অবস্থান বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। তার ভাষায়, “মেটা প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপন মোকাবিলায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে। গত ১৮ মাসে আমরা প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপনসংক্রান্ত ব্যবহারকারীর অভিযোগ ৫৮ শতাংশ কমাতে পেরেছি এবং ১৩ কোটি ৪০ লাখেরও বেশি ভুয়া বিজ্ঞাপন অপসারণ করেছি।”
অ্যান্ডি স্টোন আরও বলেন, মেটা উন্নত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিজ্ঞাপন যাচাই করছে এবং নিয়মিতভাবে সন্দেহজনক বিজ্ঞাপনদাতাদের ব্লক করছে। তবে রয়টার্সের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বিজ্ঞাপন বন্ধে ব্যবহৃত এই স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তি অনেক সময় কার্যকর হয় না, বরং প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপন একাধিক প্রোফাইল ব্যবহার করে পুনরায় সক্রিয় হয়ে পড়ে।
সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ও ডিজিটাল নীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, মেটার এই নীতিগত ব্যর্থতা শুধুমাত্র অর্থনৈতিক নয়, এটি ব্যবহারকারীর আস্থার প্রতি গভীর আঘাত।
যুক্তরাজ্যের ডিজিটাল রেগুলেশন বিশ্লেষক লুসি হুইটম্যান বলেন, “যদি মেটা সত্যিই ব্যবহারকারীর নিরাপত্তাকে প্রাধান্য দিত, তবে বিজ্ঞাপন যাচাই প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা বাড়ানো হতো এবং ন্যূনতম সন্দেহ থাকলেই বিজ্ঞাপন বন্ধ করা হতো। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, আয় নিশ্চিত করাই কোম্পানির কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।”
অন্যদিকে, মার্কিন প্রযুক্তি নীতিবিদ ড. নাথান কুপার বলেন, “এই পরিস্থিতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর বৈশ্বিক নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তাকে আরও জোরদার করছে। কারণ, যখন একটি কোম্পানি বিলিয়ন ডলারের রাজস্ব অর্জনের জন্য ব্যবহারকারীদের ঝুঁকিতে ফেলতে পারে, তখন তা শুধু ব্যবসায়িক নয়, নৈতিক সংকটও তৈরি করে।”
বিশেষজ্ঞদের মতে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এই প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপন কেবল অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ নয়—এটি ব্যবহারকারীর মানসিক নিরাপত্তা, গোপনীয়তা এবং বিশ্বাসের পরিধিও নষ্ট করছে। প্রতিদিন ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে কোটি কোটি মানুষ ছবি, তথ্য ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেন। সেই পরিবেশেই যখন প্রতারণা ঢুকে পড়ে, তখন তা ডিজিটাল নাগরিকত্বের ভিত্তিকে দুর্বল করে তোলে।
অর্থনীতিবিদদের ভাষায়, যদি এই প্রবণতা চলতেই থাকে, তবে মেটা একসময় নিজের ব্র্যান্ডমূল্য ও ব্যবহারকারীর আস্থা—উভয়ই হারাতে পারে।
রয়টার্সের প্রতিবেদনের পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা মেটার বিজ্ঞাপন যাচাই প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। ইউরোপীয় কমিশনের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, “যদি মেটা ইচ্ছাকৃতভাবে প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপন চালিয়ে থাকে বা অবহেলা করে থাকে, তবে এটি ডিজিটাল সার্ভিস অ্যাক্ট (DSA) লঙ্ঘনের আওতায় পড়তে পারে।”
এ অবস্থায় ভবিষ্যতে মেটার বিরুদ্ধে বহুমিলিয়ন ডলারের জরিমানা বা সীমিত বিজ্ঞাপন অনুমোদনসহ নানা ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
একসময় সামাজিক যোগাযোগ, স্বাধীন মত প্রকাশ ও তথ্য বিনিময়ের প্রতীক ছিল ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রাম। কিন্তু এখন, প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপনের আড়ালে যখন কোটি কোটি ডলার রাজস্ব প্রবাহিত হচ্ছে, তখন প্রশ্ন উঠছে—মেটা কি এখনো “সংযোগের প্ল্যাটফর্ম”, নাকি “মুনাফার যন্ত্র”?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেটার সামনে এখন দুটি পথ—একদিকে আর্থিক মুনাফার ধারাবাহিকতা, অন্যদিকে ব্যবহারকারীর বিশ্বাস ও নৈতিক দায়বদ্ধতা। এই দুইয়ের ভারসাম্য রক্ষা করতে না পারলে বিশ্বের বৃহত্তম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত হয়ে উঠতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



