ছবি: সংগৃহীত
বেনাপোল কাস্টমস হাউজে আমদানিকৃত পণ্য খালাসকে কেন্দ্র করে ভয়াবহ অনিয়ম, হয়রানি ও ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগের কেন্দ্রে রয়েছেন পরীক্ষণ গ্রুপ–৩–এর রাজস্ব কর্মকর্তা উদ্ভব চন্দ্র পাল এবং তাকে সহযোগিতার অভিযোগ রয়েছে প্রশাসনিক রাজস্ব কর্মকর্তা (সুপার) শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে। সিএন্ডএফ ব্যবসায়ীদের ভাষ্য অনুযায়ী, গত এক মাসে কেবল পরীক্ষণ গ্রুপ–৩ থেকেই অন্তত ২০ জন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে আনুমানিক ২৭ লাখ টাকা উৎকোচ আদায় করা হয়েছে।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, বেনাপোল বন্দরে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই উদ্ভব চন্দ্র পাল কার্যত ‘অঘোষিত নিয়ন্ত্রণ’ প্রতিষ্ঠা করেছেন। ফাইলপ্রতি নির্ধারিত অঙ্কের টাকা না দিলে তিনি স্বাক্ষর দেন না। অনেক সময় পরীক্ষণে যাওয়ার কথা থাকলেও যান না, আর গেলে নানা অজুহাত দেখিয়ে আমদানিকারকদের চাপে ফেলেন। ‘এটা হবে না, ওটা করা যাবে না’—এই ধরনের কথাবার্তার মাধ্যমে পণ্য আটকে রেখে ঘুষ আদায়ের পথ তৈরি করা হয় বলে অভিযোগ।
এই অনিয়মে প্রশাসনিক সুপার শফিকুল ইসলামের ভূমিকা নিয়েও গুরুতর প্রশ্ন তুলেছেন ব্যবসায়ীরা। অভিযোগে বলা হয়, শফিকুল ইসলামের দায়িত্ব শুল্কায়ন গ্রুপ–৪–এ থাকলেও তিনি নিয়মিত সেখানে দায়িত্ব পালন করেন না। অফিস সময়ে মাত্র দুই ঘণ্টার মতো শুল্কায়নের কাজ করে বাকি সময় উদ্ভব চন্দ্র পালের সঙ্গে প্রশাসন দপ্তরে বসে থাকেন। ফলে চার নম্বর শুল্কায়ন গ্রুপে কাজের মারাত্মক ধীরগতি তৈরি হয়েছে, যা বন্দরের সামগ্রিক বাণিজ্যিক কার্যক্রমকে স্থবির করে তুলছে।
বিশেষ করে পচনশীল ও ফলজাতীয় পণ্য আমদানিতে সমস্যার মাত্রা সবচেয়ে বেশি বলে অভিযোগ করেছেন আমদানিকারকেরা। নিয়ম অনুযায়ী, পচনশীল পণ্য কমিশনারের অনুমতি নিয়ে ভারতীয় ট্রাক থেকে বাংলাদেশি ট্রাকে দ্রুত খালাস করা হয়। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, উদ্ভব চন্দ্র পাল ট্রাকপ্রতি ১০ হাজার টাকা না দিলে গাড়ি থেকে গাড়িতে খালাসের অনুমতি দেন না। এতে করে পণ্য নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে, ব্যবসায়ীরা বড় অঙ্কের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছেন।
ব্যবসায়ীরা আরও জানান, এই অনিয়মের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুললে বা প্রতিবাদ করলে প্রশাসনিক সুপার শফিকুল ইসলামের পরামর্শে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ পাঠিয়ে অন্যত্র বদলির হুমকি দেওয়া হয়। ফলে অনেকেই ভয়ে মুখ বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেনাপোলের এক সিএন্ডএফ প্রতিনিধি বলেন, “আগে প্রতিদিন ৫০ থেকে ৭০টি কাঁচামাল ও ফলজাতীয় পণ্যবাহী ট্রাক আমদানি হতো। এখন তা কমে ১০ থেকে ১৫টিতে নেমে এসেছে। বেশিরভাগ আমদানিকারক বাধ্য হয়ে সাতক্ষীরার ভোমরা বন্দর ব্যবহার করছেন।” তিনি বলেন, “কাস্টমসে সামগ্রিকভাবে কিছুটা স্বচ্ছতা ফিরলেও দু-একজন কর্মকর্তার অনিয়মে আমরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। স্বচ্ছভাবে কাজ করতে গেলে আমাদের সঙ্গে অসহযোগিতা করা হয়।”
অভিযোগে আরও বলা হয়, পরীক্ষণ গ্রুপ–৩–এ ঘুষ আদায়ের কাজে ফল ব্যবসায়ী শামিমের কর্মচারী তৌহিদ ও জিয়া নামের দুজন ব্যক্তি সক্রিয়ভাবে টাকা সংগ্রহ করেন। আদায়কৃত টাকার প্রায় ৪০ শতাংশ প্রশাসনিক সুপার শফিকুল ইসলামের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে। এই ‘নির্দিষ্ট ভাগাভাগি’ ব্যবস্থার কারণে অনিয়ম আরও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
বেনাপোল সিএন্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের এক নেতা জানান, পরীক্ষণ গ্রুপ–৩ ও শুল্কায়ন গ্রুপ–৪–এর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তারা একাধিকবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। প্রতিবারই আশ্বাস মিললেও বাস্তবে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তার ভাষায়, “যেসব কর্মকর্তা সরকারের রাজস্ব আদায়কে বাধাগ্রস্ত করছেন, তাদের দ্রুত অপসারণ করা না হলে বন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রম ফেরানো সম্ভব নয়।”
এ বিষয়ে বেনাপোল কাস্টমস কমিশনার খালেদ মোহাম্মদ আবু হোসেন বলেন, কাস্টমসে স্বচ্ছতা ফেরাতে তারা কাজ করছেন। “শতভাগ স্বচ্ছতা একদিনে সম্ভব নয়, তবে সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে,”—বলেন তিনি।
তবে ব্যবসায়ীদের মতে, বাস্তব চিত্র ভিন্ন। অনিয়ম ও ঘুষের অভিযোগ দ্রুত তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা না নিলে বেনাপোল বন্দরের বাণিজ্য আরও সংকুচিত হবে, যা শেষ পর্যন্ত সরকারের রাজস্ব আদায়েও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
বাংলাবার্তা/এসজে
.png)
.png)
.png)



