ছবি: সংগৃহীত
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন আজ ২৯ ডিসেম্বর। শেষ মুহূর্তের এই সময়ে দেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে আলোচিত ও আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বাধীন জোটে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা। নির্বাচনের ঠিক আগমুহূর্তে এই জোট রাজনীতি নতুন করে রাজনৈতিক মেরুকরণকে তীব্র করে তুলেছে, যার সবচেয়ে বড় ধাক্কা লেগেছে এনসিপির ভেতরেই।
এর আগে বিএনপির ধানের শীষ প্রতীক পাওয়ার আশায় বিভিন্ন ছোট দলের নেতাদের দলত্যাগ করে বিএনপিতে যোগ দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। তবে জামায়াতের সঙ্গে জোটের আলোচনা শুরু হওয়ার পর এনসিপির ভেতরে যে ভাঙন, পদত্যাগ ও প্রকাশ্য আপত্তি দেখা যাচ্ছে, তা অন্য কোনো দলের ক্ষেত্রে এতটা স্পষ্টভাবে দেখা যায়নি। রাজনৈতিক অঙ্গনে এটিকে এনসিপির জন্য এক বড় রাজনৈতিক পরীক্ষার মুহূর্ত হিসেবে দেখা হচ্ছে।
এনসিপিতে পদত্যাগ ও ভাঙন
জামায়াতের সঙ্গে জোটের আলোচনা প্রকাশ্যে আসার পর থেকেই এনসিপিতে পদত্যাগের হিড়িক পড়ে। গতকাল রবিবার পর্যন্ত দলটির কেন্দ্রীয় পর্যায়ের চার নেতাসহ মোট পাঁচজন পদত্যাগ করেছেন। পাশাপাশি দলটির যুগ্ম আহ্বায়ক মনিরা শারমিন নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন।
গতকালই পদত্যাগ করেন এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক তাজনূভা জাবীন, খালেদ সাইফুল্লাহ এবং ফেনী-৩ আসনে দলটির মনোনীত প্রার্থী আবুল কাশেম। এর আগে জামায়াতের সঙ্গে আলোচনার প্রেক্ষাপটে পদত্যাগ করেন দলটির যুগ্ম সদস্যসচিব মীর আরশাদুল হক ও সিনিয়র যুগ্ম সদস্যসচিব তাসনিম জারা। এসব পদত্যাগ এনসিপির সাংগঠনিক ভিতকে নড়বড়ে করে দিয়েছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
এনসিপির ভেতরেই তীব্র ভিন্নমত
এনসিপির অনেক নেতা প্রকাশ্যেই জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক দর্শন ও অতীত ভূমিকার বিরোধিতা করে আসছেন। গত ৯ অক্টোবর দলটির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী তাঁর ফেসবুক পোস্টে স্পষ্ট ভাষায় লেখেন, ‘জামায়াতের রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। তাদের রাজনৈতিক দর্শন ও অতীত আচরণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা, মানচিত্র ও জাতীয় চেতনার পরিপন্থী। তারা যতবার ইতিহাসের মঞ্চে ফিরে আসতে চেয়েছে, ততবারই জনগণের অন্তর থেকে প্রতিবাদ উঠে এসেছে। এই দেশকে আর অন্ধকারে ফেরানো যাবে না।’
দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিনও একই সুরে কথা বলেন। গতকাল নিজের ফেসবুক পেজে তিনি লেখেন, ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী নির্ভরযোগ্য রাজনৈতিক মিত্র নয়। তাদের সঙ্গে কোনো ধরনের সহযোগিতা বা সমঝোতায় গেলে এনসিপিকে কঠিন রাজনৈতিক মূল্য দিতে হবে।’
এনসিপির অভ্যন্তরীণ বিরোধের চিত্র আরও স্পষ্ট হয় যখন জামায়াতের সঙ্গে জোট বা আসন সমঝোতার বিরোধিতা করে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির ৩০ জন সদস্য দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামকে চিঠি দেন। তবু বাস্তবতা হলো, সব আপত্তি ও ভিন্নমতের পরও এনসিপি শেষ পর্যন্ত জামায়াতের নেতৃত্বাধীন জোটেই যুক্ত হতে যাচ্ছে বলে রাজনৈতিক মহলে ধারণা করা হচ্ছে।
জামায়াতের নেতৃত্বাধীন বড় জোট
জামায়াতের নেতৃত্বাধীন এই জোটে এনসিপির পাশাপাশি থাকছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা), বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস ও খেলাফত মজলিস। এছাড়া লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) ও এবি পার্টির নাম নিয়েও রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা চলছে।
এই জোট গঠনের মাধ্যমে জামায়াত একটি বড় ইসলামপন্থী ও সমমনা রাজনৈতিক বলয় তৈরি করতে চাইছে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। আর এনসিপির যুক্ত হওয়া এই জোটকে তরুণ নেতৃত্বের একটি নতুন বৈধতা দেওয়ার প্রচেষ্টা হিসেবেও ব্যাখ্যা করা হচ্ছে।
বিএনপি জোটে ব্যাপক পুনর্গঠন
অন্যদিকে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটেও বড় ধরনের পুনর্গঠন দেখা যাচ্ছে। বিএনপির সমর্থনে দলীয় প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাইফুল হক, নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না, গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকি ও গণঅধিকার পরিষদের নুরুল হক নুর।
এনডিএম চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ বিএনপিতে যোগ দিয়ে ধানের শীষ প্রতীক নিচ্ছেন। বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম তাঁর দল বিলুপ্ত করে বিএনপিতে যোগ দিয়ে লক্ষ্মীপুর-১ আসন থেকে নির্বাচন করছেন। জাতীয় দল বিলুপ্ত করে বিএনপিতে যোগ দিয়েছেন সৈয়দ এহসানুল হুদা, যিনি কিশোরগঞ্জ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তাঁর পদত্যাগের পর ১২ দলীয় জোট কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে।
এছাড়া গণঅধিকার পরিষদের প্রতিষ্ঠাকালীন সাধারণ সম্পাদক মো রাশেদ খান বিএনপিতে যোগ দিয়ে ঝিনাইদহ-৪ আসন থেকে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করছেন। এলডিপির মহাসচিব রেদোয়ান আহমেদ বিএনপিতে যোগ দিয়ে কুমিল্লা-৭ আসনে প্রার্থী হচ্ছেন। যদিও তাঁর পদত্যাগের পর এলডিপি এককভাবে নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে, তবু দলটির একটি অংশ জামায়াত জোটে যেতে পারে বলে আলোচনা রয়েছে।
বিএনপি ইতিমধ্যে ২৭২টি আসনে দলীয় প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে। বাকি ২৮টি আসন শরিকদের জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশকে পাঁচটি আসন দেওয়া হয়েছে, যেখানে তারা নিজ দলের প্রতীকে নির্বাচন করবে। বিজেপির চেয়ারম্যান আন্দালিভ রহমান পার্থও বিএনপি জোটে থেকে নিজ দলের প্রতীকে ভোলা-১ আসনে নির্বাচন করছেন।
বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য ড. আব্দুল আলীম মনে করেন, এই মেরুকরণের পেছনে বড় কারণ হচ্ছে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) যুক্ত নতুন বিধান। তিনি বলেন, জোটবদ্ধ হলেও দলগুলোকে নিজ নিজ প্রতীকে নির্বাচন করতে হবে—এই বিধান ছোট দলগুলোর জন্য বড় চাপ তৈরি করেছে। ফলে অনেক নেতা বড় দলে যোগ দিয়ে বড় প্রতীকে নির্বাচন করতে চাইছেন।
ড. আলীমের মতে, এনসিপির ক্ষেত্রে বিষয়টি আলাদা। তিনি বলেন, ‘জামায়াতের নেতৃত্বাধীন জোটে যোগ দেওয়া নিয়ে এনসিপির যে ভাঙন, তা হতাশাজনক। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের এই দল যদি ভেঙে যায়, তাহলে রাষ্ট্র সংস্কারের স্বপ্ন আরও দূরে সরে যাবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. দিল রওশন জিন্নাত আরা নাজনীন বলেন, নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক মেরুকরণ বাংলাদেশে নতুন নয়। তাঁর ভাষায়, ‘তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতিতে আদর্শের চেয়ে নির্বাচনে জেতার হিসাবটাই বড় হয়ে ওঠে। এনসিপি নতুন দল, অভিজ্ঞতাও কম। এককভাবে তারা বড় সাফল্য পাবে না—এটা অনুমেয় ছিল। তাই শেষ পর্যন্ত কোনো না কোনো জোটে যেতেই হতো। দর-কষাকষিতে জামায়াত হয়তো বেশি সুবিধা দিয়েছে, তাই সেখানেই যাচ্ছে।’
সব মিলিয়ে মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিনে দাঁড়িয়ে দেশের রাজনীতি স্পষ্টভাবে দুই বড় জোটে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এই মেরুকরণ শেষ পর্যন্ত ভোটের মাঠে কী প্রভাব ফেলবে এবং এনসিপির ভবিষ্যৎ কোন পথে যাবে—সেটিই এখন রাজনীতির সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



