ছবি: সংগৃহীত
দরজায় কড়া নাড়ছে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। দীর্ঘ সময় পর অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া এই নির্বাচন ঘিরে বড় দল হিসেবে বিএনপির প্রস্তুতিও সবচেয়ে আলোচনায়। ইতিমধ্যে দলটি প্রার্থীতালিকা চূড়ান্ত করে অধিকাংশ আসনে দলীয় মনোনয়ন দিয়েছে। তবে বড় দল হওয়ায় এবং দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকায় প্রার্থী বাছাই নিয়ে বিএনপির ভেতরে তৈরি হয়েছে তীব্র চাপ, অসন্তোষ ও অস্থিরতা। মনোনয়ন না পাওয়া অনেক নেতা-কর্মী প্রকাশ্য বিক্ষোভে নেমেছেন, কোথাও কোথাও পরিস্থিতি বিদ্রোহী প্রার্থী দেওয়ার পর্যায়েও পৌঁছেছে।
দলীয় সূত্র, স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মী এবং বিভিন্ন জেলার সম্ভাব্য প্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মনোনয়ন না পাওয়ায় ক্ষুব্ধ নেতাদের একটি অংশ শেষ পর্যন্ত স্বতন্ত্র বা বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কেউ কেউ ইতিমধ্যে মনোনয়নপত্রও সংগ্রহ করেছেন। এতে করে ভোটের মাঠে বিএনপির জন্য বড় ধরনের অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা।
অসন্তোষ, বিক্ষোভ আর হুঁশিয়ারি
বিএনপির দায়িত্বশীল একাধিক নেতা জানিয়েছেন, মনোনয়ন না পেয়ে যাঁরা বিদ্রোহী প্রার্থী হবেন, তাঁদের দলীয় শৃঙ্খলার আওতায় আনা হবে। তাঁদের ভাষায়, বিদ্রোহ মানে দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যাওয়া, যা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে দেওয়া প্রতিশ্রুতিরও লঙ্ঘন। দলীয় হাইকমান্ড এটি কোনোভাবেই ইতিবাচকভাবে দেখবে না।
তবুও মাঠপর্যায়ের চিত্র ভিন্ন। কোনো কোনো এলাকায় মনোনয়ন ঘোষণার পর সমর্থকেরা রেলপথ অবরোধ করেছেন, কোথাও মহাসড়কে আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ হয়েছে। দলীয় সূত্র বলছে, দীর্ঘদিন ধরে সুষ্ঠু নির্বাচন না হওয়ায় বিএনপিতে যোগ্য ও ত্যাগী নেতার সংখ্যা বেড়েছে। অনেক আসনেই চার-পাঁচজন প্রার্থী জনপ্রিয় ও সাংগঠনিকভাবে শক্ত অবস্থানে আছেন। কিন্তু প্রার্থী হতে পারবেন একজনই—এই বাস্তবতা থেকেই ক্ষোভের বিস্ফোরণ।
বিএনপির নেতারা অবশ্য বলছেন, কয়েক দফা গোপন জরিপ ও জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের ভিত্তিতেই প্রার্থী চূড়ান্ত করা হয়েছে। প্রায় ৯০ শতাংশ আসনে জনমত জরিপের ফলাফল বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে বলে দাবি তাঁদের।
নির্বাচনসূচি ও বিদ্রোহের সময়সীমা
নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, আজ ২৯ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ সময় ২০ জানুয়ারি। ২১ জানুয়ারি প্রকাশ হবে চূড়ান্ত প্রার্থীতালিকা ও প্রতীক বরাদ্দ। ফলে ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত সময়টুকু বিএনপির জন্য সবচেয়ে স্পর্শকাতর। এই সময়ের মধ্যে অসন্তুষ্ট প্রার্থীদের সামলাতে না পারলে বিদ্রোহী প্রার্থী ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করছেন দলের নীতিনির্ধারকেরা।
যেসব আসনে বিদ্রোহের শঙ্কা বেশি
সবচেয়ে আলোচিত নাম বিএনপির সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে জোর প্রচারণা চালাচ্ছেন। এই আসনে বিএনপি ধানের শীষ প্রতীক দেয়নি; বরং জোট শরিক জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের নেতা মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিবকে সমর্থন দিয়েছে। রুমিন ফারহানা নিজেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে তুলে ধরে বলেছেন, এলাকার মানুষের সিদ্ধান্তই তাঁর কাছে চূড়ান্ত।
কুমিল্লা-৭ (চান্দিনা) আসনে মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবিতে কাফনের কাপড় পরে বিক্ষোভ হয়েছে। এখানে এলডিপি থেকে বিএনপিতে যোগ দেওয়া ড. রেদোয়ান আহমেদ দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন। কিন্তু চান্দিনা উপজেলা বিএনপির সভাপতি আতিকুল শাওন স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে পারেন বলে আলোচনা চলছে।
ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে জেলা বিএনপির সদস্য আক্তারুজ্জামান বাচ্চুকে মনোনয়ন দেওয়ার প্রতিবাদে রেলপথ অবরোধ হয়েছে। এ বি সিদ্দিকুর রহমানের সমর্থকেরা এই বিক্ষোভ করেন। তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। একই জেলায় ময়মনসিংহ-১১ আসনে মুহাম্মদ মুরশেদ আলম স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
কিশোরগঞ্জ-৫ আসনে দল বিলুপ্ত করে বিএনপিতে যোগ দেওয়া সৈয়দ এহসানুল হুদা মনোনয়ন পেলেও স্থানীয় নেতা শেখ মজিবুর রহমান ইকবাল স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে পারেন। তিনি ইতিমধ্যে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন।
ঝিনাইদহ-৪ আসনে গণঅধিকার পরিষদের রাশেদ খানকে বিএনপি মনোনয়ন দেওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হচ্ছেন কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা সাইফুল ইসলাম ফিরোজ। তাঁর দাবি, যাঁকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে, তিনি বিএনপির নেতা নন।
নোয়াখালী-২ আসনে কাজী মফিজুর রহমান, নোয়াখালী-৬ আসনে প্রকৌশলী ফজলুল আজিম, চট্টগ্রাম-১৬ আসনে মো. লেয়াকত আলী, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একাধিক আসন, টাঙ্গাইল-৬, ময়মনসিংহ-৮, জামালপুর-৩, মেহেরপুর-২, নড়াইল-২, নারায়ণগঞ্জের কয়েকটি আসন এবং পাবনা-৩ ও রাজশাহী-৫ আসনেও বিদ্রোহী প্রার্থীর শঙ্কা রয়েছে।
কিছু কিছু আসনে একাধিক নেতা মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে তিনবারের এমপি আবুল কালাম ও মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক সাখাওয়াত হোসেন খানের নাম ঘুরছে। পাবনা-৩ আসনে সাবেক এমপি কে এম আনোয়ারুল ইসলাম প্রকাশ্যেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মাঠে নেমেছেন।
হাইকমান্ডের কঠোর বার্তা
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন, বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাঁর ভাষায়, ‘দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করলে আজীবন বহিষ্কারসহ কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
তবে স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু কিছুটা নমনীয় অবস্থান তুলে ধরেন। তিনি বলেন, মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন পর্যন্ত কাউকে বিদ্রোহী বলা যাবে না। এই সময়ের মধ্যে দল অসন্তুষ্টদের বোঝানোর চেষ্টা করবে। এরপরও কেউ থাকলে, তাঁদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সামনে কঠিন পরীক্ষা
সব মিলিয়ে নির্বাচনের ঠিক আগে বিএনপি বড় এক অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার মুখে। একদিকে সরকারবিরোধী আন্দোলনের ধারাবাহিকতা ধরে রেখে ভোটের মাঠে শক্ত অবস্থান গড়ে তোলা, অন্যদিকে নিজ দলের ভেতরের ক্ষোভ ও বিদ্রোহ সামাল দেওয়া—এই দুই চ্যালেঞ্জ একসঙ্গে মোকাবিলা করতে হচ্ছে দলটিকে। মনোনয়ন নিয়ে তৈরি এই অস্থিরতা শেষ পর্যন্ত কতটা নিয়ন্ত্রণে আনা যায়, সেটিই নির্ধারণ করবে নির্বাচনী রাজনীতিতে বিএনপির ভবিষ্যৎ পথ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



