
ছবি: সংগৃহীত
রাষ্ট্রায়ত্ত বিমান সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের নিরাপত্তা ও কার্যক্রম নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে। গত এক মাসে অন্তত ১৬টি ফ্লাইটে যান্ত্রিক ত্রুটি ধরা পড়েছে, যার মধ্যে বেশ কয়েকটি মাঝ আকাশ থেকে ফিরে এসেছে, কিছু ফ্লাইট রানওয়েতে থেমে গেছে, আবার কিছু বাতিল হয়েছে। এর ফলে যাত্রীদের ভোগান্তি, আর্থিক ক্ষতি এবং ব্র্যান্ড ইমেজে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
বারবার ত্রুটি, যাত্রীরা আতঙ্কে
গত কয়েক মাস ধরে বিমানের উড়োজাহাজে একের পর এক ত্রুটি ধরা পড়ছে। কখনো ইঞ্জিনের সমস্যা, কখনো কেবিনের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া, কখনো আবার শৌচাগারের পয়োবর্জ্য ব্যবস্থার ত্রুটি—সব মিলিয়ে নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা বাড়ছে। ফ্লাইট বাতিল, দীর্ঘ বিলম্ব, হোটেলে রাত কাটানো—এসব এখন যাত্রীদের কাছে প্রায় নিত্যদিনের ঘটনা।
ঢাকা থেকে নিয়মিত ভ্রমণকারী ব্যবসায়ী হাসান মাহমুদ বলেন, "বিমানের ফ্লাইটে উঠলে মনে হয়, গন্তব্যে পৌঁছাব কি না সেটা ভাগ্যের ওপর নির্ভর করছে। সময়মতো পৌঁছানো এখন বিলাসিতা হয়ে গেছে।"
সবচেয়ে আলোচিত সাম্প্রতিক ঘটনা
-
১১ আগস্ট: ঢাকা থেকে চট্টগ্রামগামী বিজি-৬১৫ (ড্যাশ-৮) কেবিনের তাপমাত্রা অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় উড্ডয়নের ২০ মিনিট পর ঢাকায় ফিরে আসে।
-
১০ আগস্ট: রোম থেকে ঢাকাগামী বিজি-৩৫৬ (বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার) ডানার ফ্ল্যাপ কাজ না করায় ফ্লাইট বাতিল। ২৬২ যাত্রী হোটেলে অবস্থান করছেন।
-
৯ আগস্ট: সিঙ্গাপুর থেকে ঢাকামুখী বিজি-৫৮৫ ফ্লাইটের ইঞ্জিনে ত্রুটি। দুই ঘণ্টা মেরামতের পর যাত্রা।
-
৭ আগস্ট: আবুধাবিগামী বিজি-৩২৭ মাঝ আকাশ থেকে ফিরিয়ে আনা হয় শৌচাগারের ফ্লাশ কাজ না করায়।
-
৬ আগস্ট: ব্যাংককগামী ফ্লাইট ইঞ্জিনে কম্পনের কারণে মিয়ানমারের আকাশ থেকে জরুরি অবতরণ।
-
২৮ জুলাই: দাম্মামগামী ফ্লাইট যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ফিরে আসে।
-
১৬ জুলাই: দুবাইয়ে বোয়িং উড়োজাহাজের চাকা ফেটে ফ্লাইট স্থগিত।
-
জুলাইয়ের শুরু: জেদ্দায় অবতরণের পর বোয়িংয়ের চাকায় ত্রুটি ধরা পড়ে।
সমস্যার মূল কোথায়?
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এগুলো কেবল দুর্ঘটনাজনিত বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বরং দীর্ঘদিন ধরে রক্ষণাবেক্ষণে অবহেলা, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাব এবং ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের কাঠামোগত দুর্বলতা এর মূল কারণ।
বেসামরিক বিমান চলাচল বিশেষজ্ঞ গ্রুপ ক্যাপ্টেন (অব.) কামরুল ইসলাম বলেন, “বিমানের টেকনিক্যাল লগবুকে যদি ত্রুটি নথিভুক্ত করা হয় কিন্তু তা সঠিকভাবে সমাধান না হয়, তাহলে এটি শুধু অপেশাদারিত্ব নয়, বরং যাত্রীদের জীবনের প্রতি চরম অবহেলা। এটি যেকোনো দিন বড় দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে।”
আরেক বিশেষজ্ঞ, এয়ার সেফটি কনসালট্যান্ট ক্যাপ্টেন মাহবুবুল আলম বলেন, “প্রতিটি ফ্লাইটের আগে এবং পরে কঠোর মাননিয়ন্ত্রণ চেক থাকা উচিত। কিন্তু আমাদের দেশে তা অনেক সময় ‘টিক চিহ্ন’ দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। আন্তর্জাতিক এয়ারলাইনসগুলোতে নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও অডিট হয়, যা আমাদের বিমানে বাড়াতে হবে।”
গাফিলতি নাকি ষড়যন্ত্র?
বিমানের ভেতরের কিছু কর্মকর্তা মনে করছেন, এই ঘন ঘন ত্রুটির পেছনে শুধু প্রযুক্তিগত দুর্বলতা নয়, অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রও থাকতে পারে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিমানের এক কর্মকর্তা বলেন, “ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে সংস্কার জরুরি। একই সঙ্গে নিশ্চিত হতে হবে, কোনো গোষ্ঠী ইচ্ছাকৃতভাবে ফ্লাইটে ত্রুটি তৈরি করছে কিনা।”
একজন অভিজ্ঞ বৈমানিক আরাফাত ইসলাম বলেন, “পাইলটরা প্রতিটি ফ্লাইটের পর সব ত্রুটি লগবুকে লিখে দেন। মেরামত না করে যদি বিমান আবার প্রস্তুত বলে দেখানো হয়, তবে সেটা সরাসরি নিরাপত্তা লঙ্ঘন। এই অবস্থায় সেফটি ডিপার্টমেন্টের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ।”
অর্থনৈতিক ক্ষতি ও সুনামের ধস
প্রতিটি বাতিল বা বিলম্বিত ফ্লাইটের ফলে বিমান শুধু রাজস্ব হারাচ্ছে না, বরং হোটেল খরচ, যাত্রী ক্ষতিপূরণ ও পুনঃতালিকা তৈরির মতো অতিরিক্ত খরচও বহন করছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের পতাকাবাহী এই সংস্থার সুনাম মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
অর্থনীতিবিদ ড. মেহেদী হাসান বলেন, “বিমান শুধু পরিবহন খাত নয়, এটি দেশের ভাবমূর্তির প্রতীক। এখানে নিরাপত্তা বা সেবা মানের অবনতি হলে তা পর্যটন ও বিদেশি বিনিয়োগেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।”
কর্তৃপক্ষের প্রতিক্রিয়া
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল হাসান মাহমুদ সিদ্দিক জানিয়েছেন, “বিমান বাংলাদেশসহ সব এয়ারলাইন্সের কার্যক্রম নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। আকাশ থেকে কেন ফ্লাইট ফেরত আসছে, সেই কারণগুলো বিস্তারিতভাবে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। নিরাপত্তার বিষয়ে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।”
প্রয়োজন কঠোর সংস্কার ও নজরদারি
বিশেষজ্ঞদের মতে, এখনই জরুরি ভিত্তিতে—
-
ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের কাঠামোগত সংস্কার
-
আন্তর্জাতিক মানের রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিদর্শন প্রক্রিয়া
-
পাইলট ও ইঞ্জিনিয়ারদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ
-
স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক সেফটি অডিট
গ্রহণ করতে হবে। নইলে যান্ত্রিক ত্রুটি থেকে বড় ধরনের দুর্ঘটনার ঝুঁকি থেকে মুক্তি মিলবে না।
বাংলাবার্তা/এমএইচ