
ছবি: সংগৃহীত
জুলাই অভ্যুত্থানের এক বছর পেরিয়ে গেল। এই সময়ের মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিচার বিভাগ সংস্কারে বেশকিছু উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সুপ্রিমকোর্টে বিচারক নিয়োগ থেকে শুরু করে দণ্ডবিধি ও ফৌজদারি কার্যবিধি সংস্কার, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার, দুর্নীতিগ্রস্ত বিচারপতিদের অপসারণ, আইনি কাঠামোর উন্নয়ন—সকল ক্ষেত্রেই দৃশ্যমান পরিবর্তনের ছাপ পাওয়া গেছে। তবে এখনো সুপ্রিমকোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় বিচার বিভাগে কাঙ্ক্ষিত স্বতন্ত্রতা আসেনি বলে অনেকের মত।
সুপ্রিমকোর্ট সচিবালয় এখনো আলোর মুখ দেখেনি
যদিও বিচার বিভাগ সংস্কারে কিছু গুরুত্বপূর্ণ অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে, সুপ্রিমকোর্টের জন্য পৃথক সচিবালয় এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এই অনুপস্থিতি বিচারকদের বদলি ও পদায়ন, বাজেট বরাদ্দসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিলম্ব ঘটাচ্ছে। সুপ্রিমকোর্টের স্পেশাল অফিসার মোয়াজ্জেম হোছাইন জানান, প্রধান বিচারপতির প্রস্তাবিত রোডম্যাপ অনুযায়ী সংস্কারের কাজ চলছে এবং সচিবালয় প্রতিষ্ঠা হলে বহু সমস্যা দূর হবে।
অপসারিত বিচারপতি ও বছরজুড়ে বিক্ষোভ
বিচার বিভাগে দলবাজ ও দুর্নীতিবাজ বিচারপতিদের বিরুদ্ধে আন্দোলন ছিল বছরজুড়ে। বিভিন্ন আইনজীবী সংগঠন ও নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আন্দোলনের মুখে ১২ বিচারপতিকে বিচারকাজ থেকে বিরত রাখা হয়। এর আগে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানসহ আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতি পদত্যাগ করেন।
আইন সংস্কারে বছরজুড়ে কর্মতৎপরতা
আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল জানান, গত এক বছরে অন্তর্বর্তী সরকার ব্যাপক আইন সংস্কার করেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশসহ একাধিক আইন যুগোপযোগী করা হয়েছে। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করে নতুন অধ্যাদেশ জারি করা, যাতে আগের নিপীড়নমূলক ধারা ও মামলাগুলো বাতিল হয়।
বিচারপতি নিয়োগে নতুন কাঠামো
আইনের মাধ্যমে গঠিত জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কাউন্সিল ইতিমধ্যে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে নতুন বিচারপতি নিয়োগের উদ্যোগ নিয়েছে। ৫৯ জন প্রার্থীর মৌখিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে, যারা উত্তীর্ণ হবেন তাদের নাম রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের জন্য প্রেরণ করা হবে। অনুমোদন পেলে আইন মন্ত্রণালয় গেজেট প্রকাশ করবে।
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু
জুলাই অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ ও আগের সরকারের শাসনামলে সংঘটিত গুম, খুন, নির্যাতনের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৪৫০টির বেশি অভিযোগ জমা পড়েছে। এর মধ্যে ৩০টি মামলা করা হয়েছে। চারটি মিস কেস নিয়মিত মামলায় পরিণত হয়েছে। শেখ হাসিনাসহ ২০৯ জন আসামির বিরুদ্ধে বিচার চলছে, যার মধ্যে ৮৪ জন গ্রেফতার এবং ১৩২ জন পলাতক রয়েছেন। কিছু মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছে, যেমন রাজধানীর চানখাঁরপুল, আশুলিয়া ও রংপুরে সংঘটিত গণহত্যা ও হত্যাকাণ্ড।
রাজনৈতিক সংগঠনকে শাস্তির বিধান
২০২৫ সালের ১০ মে সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন সংশোধন করে ট্রাইব্যুনালকে রাজনৈতিক দল, তাদের অঙ্গসংগঠন ও সমর্থক গোষ্ঠীকে শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা দেয়। এই সংশোধনীর মাধ্যমে সংগঠনের বিরুদ্ধে দায় নিশ্চিত করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। প্রসিকিউশন বলছে, এটি একটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ।
বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট
আট সদস্যের বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের ৩৫২ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে ৩১টি অধ্যায়ে বহু সুপারিশ ও প্রস্তাব রয়েছে। সুপ্রিমকোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠা, বিচারপতি নিয়োগ ও শৃঙ্খলা, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা, আদালতের বিকেন্দ্রীকরণ, স্বাধীন বাজেট, মিথ্যা মামলা প্রতিরোধ, দুর্নীতি প্রতিরোধ, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত বিচার—প্রতিটি বিষয়ে সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রধান বিচারপতির রোডম্যাপ
প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ ২১ সেপ্টেম্বর উভয় বিভাগের বিচারপতি ও জেলা জজদের উপস্থিতিতে বিচার বিভাগ সংস্কারে একটি রোডম্যাপ পেশ করেন। সেখানে তিনি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, পৃথক সচিবালয়, বাজেট বরাদ্দ, নীতিমালা প্রণয়ন, প্রশিক্ষণ, মেধা চর্চা, নিয়োগে স্বচ্ছতা এবং দুর্নীতি প্রতিরোধের উপর গুরুত্বারোপ করেন।
পুরনো মামলার নিষ্পত্তি ও রাজনৈতিক বন্দিমুক্তি
এই এক বছরে পুরনো কিছু মামলার শুনানি শুরু হয়েছে। ফলে দীর্ঘদিন কারাবন্দি থাকা কয়েকজন রাজনীতিবিদ মুক্তি পেয়েছেন। যা বিচার বিভাগের প্রতি জনআস্থার পুনর্গঠনে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে।
জুলাই অভ্যুত্থানের পর বিচার বিভাগে যেসব পরিবর্তন এসেছে তা ইতিবাচক হলেও সুপ্রিমকোর্ট সচিবালয়ের অনুপস্থিতি একটি বড় সীমাবদ্ধতা হিসেবে থেকে গেছে। আইন সংস্কার, বিচারক নিয়োগ, দুর্নীতিবিরোধী উদ্যোগ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার বিচার বিভাগের অগ্রগতি নিশ্চিত করেছে, কিন্তু কাঠামোগত ও আর্থিক স্বাধীনতা না এলে এই অগ্রগতি স্থায়ী হবে না—এমনটাই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ