ছবি: সংগৃহীত
দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে কিছু মৃত্যু কেবল একটি প্রাণের অবসান নয়, বরং তা হয়ে ওঠে একটি জাতির সম্মিলিত বেদনা, আত্মজিজ্ঞাসা ও বিবেকের নাড়া। সদ্য শহীদ শরিফ ওসমান বিন হাদির শাহাদাত ঠিক তেমনই এক ঘটনা। এই মৃত্যু যেন ব্যক্তিগত শোকের সীমা পেরিয়ে সামাজিক ও জাতীয় শোকের রূপ নিয়েছে—যার ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া সহজ নয়, অথচ গভীরভাবে অনুভবযোগ্য।
একজন অশীতিপর বৃদ্ধ মানুষের জীবনে বহু মৃত্যু এসেছে–গেছে। বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়স্বজন—এদের বিদায় স্বাভাবিকভাবেই হৃদয়বিদারক। কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পর্কহীন, অপরিচিত বা দূর-পরিচিত কারও মৃত্যু সাধারণত তেমনভাবে অন্তরে দাগ কাটে না। অথচ শহীদ ওসমান হাদির ক্ষেত্রে এই স্বাভাবিক সূত্রটি যেন ভেঙে গেছে। তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে না চিনেও অসংখ্য মানুষ গভীরভাবে শোকাহত, অশ্রুসিক্ত। এই ব্যতিক্রমই প্রশ্ন তোলে—কেন?
সব মৃত্যুই বেদনাদায়ক, তবে বেদনার গভীরতা নির্ভর করে সম্পর্কের প্রকৃতি ও গভীরতার ওপর। সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শোক সাধারণত সীমিত থাকে। কিন্তু শহীদ ওসমান হাদির মৃত্যুতে সেই সীমা ভেঙে পড়েছে। তিনি যেন ছিলেন সবার পরিচিত একজন—যদিও বাস্তবে অনেকেই তাঁকে কখনো সামনে থেকে দেখেননি, কথা বলেননি। তবু মানুষ তাঁকে আপন করে নিয়েছে। এর কারণ খুঁজতে গেলে চোখ রাখতে হয় তাঁর জীবন, দর্শন ও অবস্থানের দিকে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন ও তাঁর দেওয়া সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারগুলো বিশ্লেষণ করলে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে—ওসমান হাদি ছিলেন ব্যতিক্রমধর্মী রাজনীতিবিদ। তাঁর রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় স্বার্থ। ক্ষমতা, পদ-পদবি বা ব্যক্তিগত লাভালাভ তাঁর রাজনীতির লক্ষ্য ছিল না—এমনটাই প্রতীয়মান হয়েছে তাঁর বক্তব্য ও আচরণে।
শাহাদাতের মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে তাঁকে দেখা গেছে অত্যন্ত বিনয়ী ও নিবেদিতপ্রাণ এক মানুষ হিসেবে। সেখানে তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন, রাজনীতিতে তাঁর কোনো ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া নেই। তিনি চান একটি স্বাধীন, মর্যাদাশীল ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন বাংলাদেশ। আরও বিস্ময়কর বিষয় হলো—তিনি সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করেছিলেন, যেন সৎ রাজনীতির পথেই থাকা অবস্থায় তাঁকে এই দুনিয়া থেকে তুলে নেওয়া হয়। এই প্রার্থনা কাকতালীয় নাকি গভীর আত্মোপলব্ধির ফল—তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। তবে এতে কোনো সন্দেহ নেই, এটি একজন নির্লোভ ও আদর্শবাদী রাজনীতিবিদের মানসিকতারই প্রতিফলন।
শহীদ ওসমান হাদির হত্যাকাণ্ড নিঃসন্দেহে একটি নৃশংস ও রহস্যঘেরা ঘটনা। দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ এই হত্যার পেছনের কারণ ও অপরাধীদের শনাক্ত করতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে—এমন আশ্বাসও এসেছে। সাম্প্রতিক সময়ে কিছু অপরাধ উদঘাটনের নজির জনগণের আস্থাকে কিছুটা হলেও দৃঢ় করেছে। তবে একটি বিষয় লক্ষণীয়—ওসমান হাদির কোনো প্রকাশ্য রাজনৈতিক শত্রু ছিল বলে শোনা যায় না। তিনি সংঘাতমুখী রাজনীতির মানুষ ছিলেন না।
তবু প্রশ্ন থেকেই যায়—তাহলে কারা, কেন তাঁকে লক্ষ্যবস্তু বানাল? অনেকের ধারণা, তাঁর আপসহীন দেশপ্রেম, অকপট দেশাত্মবোধক বক্তব্য ও স্বাধীনতার প্রশ্নে দৃঢ় অবস্থান কোনো কোনো স্বার্থান্বেষী মহলের জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠেছিল। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়—যেখানে নৈতিকতা শক্তিশালী হয়, সেখানে অনৈতিকতার সঙ্গে তার সংঘর্ষ অনিবার্য। আর সেই সংঘর্ষে অনেক সময় সত্যই প্রথম আঘাতের শিকার হয়।
ওসমান হাদির শাহাদাতের পর সবচেয়ে বিস্ময়কর দৃশ্য ছিল তাঁর জানাজা। দল-মত নির্বিশেষে লাখ লাখ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি যেন নতুন এক ইতিহাস রচনা করেছে। কোনো রাজনৈতিক ব্যানার ছিল না, কোনো সংগঠনের নির্দেশনা ছিল না, ছিল না পরিবহন ভাড়া বা খাবারের প্যাকেট। মানুষ শুধু শুনেছে—অমুক দিন, অমুক জায়গায় শহীদ ওসমান হাদির জানাজা। এই খবরই যথেষ্ট ছিল। মানুষ ঢল নামিয়েছে পঙ্গপালের মতো।
এই বিশাল জনসমাবেশ দেখে অনেকেই বিস্মিত হয়েছেন। ওসমান হাদি কোনো বড় রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা ছিলেন না। তাঁর পাড়ায় পাড়ায় সংগঠন ছিল না, ছিল না চোঙা ফুঁকানো বাহিনী, ছিল না শক্তিশালী প্রচারযন্ত্র। তবু মানুষ এসেছে—নিজের তাগিদে, নিজের আবেগে। এই ভালোবাসা কি কৃত্রিম? না। এটি ছিল মানুষের অন্তর থেকে উৎসারিত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।
তাহলে প্রশ্ন আসে—কী ছিল তাঁর কাছে, যা মানুষকে এমনভাবে টেনে এনেছে? উত্তরটি খুব জটিল নয়। এক কথায়—দেশপ্রেম। নিঃস্বার্থ দেশপ্রেম। এমন দেশপ্রেম, যা বক্তব্যে নয়, আচরণে প্রকাশ পায়। এমন দেশপ্রেম, যা ক্ষমতার লোভে আপস করে না।
মানুষ যেন অনুভব করেছে—এই মানুষটি তাদের জন্য কিছু রেখে যেতে পারেননি সম্পদ বা ক্ষমতার উত্তরাধিকার হিসেবে। কিন্তু রেখে গেছেন আরও বড় কিছু—নিজের সমস্ত অন্তরাত্মা দিয়ে জড়িয়ে ধরা একটি লাল-সবুজ পতাকা। সেই পতাকাই এখন তাঁর উত্তরাধিকার। সেই পতাকার প্রতিই মানুষের দায়বদ্ধতা।
এই জনসমুদ্র রাজনৈতিক দলগুলোর জন্যও একটি বড় বার্তা বহন করে। সাধারণ মানুষ কী চায়, কাকে সম্মান করে—তা এই জানাজাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। প্রশ্ন হলো, রাজনৈতিক দলগুলো কি এই বার্তা বুঝবে? নাকি ক্ষমতার মোহে আচ্ছন্ন হয়ে আবারও মানুষের এই নিঃশব্দ আর্তিকে উপেক্ষা করবে?
শহীদ ওসমান হাদির শাহাদাত আমাদের সামনে একটি আয়না তুলে ধরেছে। সেই আয়নায় দেখা যাচ্ছে—মানুষ এখনো আদর্শকে ভালোবাসে, দেশপ্রেমকে সম্মান করে, ত্যাগকে স্মরণ রাখে। এই ভালোবাসা কোনো দলের জন্য নয়, কোনো মতাদর্শের জন্য নয়—এই ভালোবাসা একজন সৎ, নির্ভীক ও দেশপ্রেমিক মানুষের জন্য। আর এখানেই শহীদ ওসমান হাদির প্রতি মানুষের ভালোবাসার গভীরতম কারণ লুকিয়ে আছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



