ছবি: সংগৃহীত
হাড়কাঁপানো কনকনে শীত। চারদিকে যখন কুয়াশার চাদর আর নিস্তব্ধতা, তখন শাহবাগ মোড় যেন এক জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি। ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শহীদ শরিফ ওসমান হাদির হত্যার বিচারের দাবিতে গভীর রাতেও থমথমে শাহবাগ। রাত বাড়ার সঙ্গে বাড়ছে মানুষও। আন্দোলনে যোগ দিতে রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে ছুটে আসছেন ছাত্র-জনতা।

শুক্রবার (২৬ ডিসেম্বর) দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে সরেজমিনে দেখা যায়, মধ্যরাতের হিমেল হাওয়ায় শরীর গরম রাখতে কেউ কম্বল গায়ে জড়িয়েছেন, কেউ বা একে অপরের কাঁধে হাত রেখে গোল হয়ে বসে আছেন। তবে চোখেমুখে ক্লান্তি নেই, আছে দ্রোহ। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ (রাকসু) সাধারণ সম্পাদক সালাউদ্দীন আম্মার এবং ইনকিলাব মঞ্চের সদস্য সচিব আবদুল্লাহ আল জাবের স্লোগান দিচ্ছেন। তাদের স্লোগানে কেঁপে উঠছে রাজপথ।
‘হাদি মানে আজাদি, হাদি মানে ইনসাফ’ ‘এক হাদির রক্ত থেকে, লক্ষ হাদি জন্ম নেবে’ ‘তুমি কে আমি কে হাদি হাদি’ ‘ভারতের দালালেরা, হুঁশিয়ার সাবধান’ ‘আপস না হাদি, হাদি’ ‘আওয়ামী লীগের চামড়া, তুলে নেব আমরা’ ‘হাদি ভাইয়ের রক্ত, বৃথা যেতে দেব না’ স্লোগানে কম্পিত হচ্ছে শাহবাগ।

আন্দোলনের সম্মুখ সারিতে রয়েছেন নারীরা।
রাত ৩টার দিকে আন্দোলনে এসে যোগ দেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আব্দুল্লাহ ও এনসিপির যুগ্ম সদস্যসচিব এস এম সাইফ মোস্তাফিজ। তারা এসে ছাত্র-জনতার সঙ্গে রাস্তায় বসে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন।

মাঝরাতে ছাত্র-জনতার সঙ্গে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন হাসনাত আবদুল্লাহ।
রাকসুর জিএস সালাহউদ্দিন আম্মার বলেন, 'যতক্ষণ পর্যন্ত আমার সহযোদ্ধা ওসমান হাদি হত্যার বিচার না হবে ততক্ষণ আমরা এই রাজপথ ছাড়ব না। উপদেষ্টারা এখানে এসে আমাদের জানাতে হবে তারা এ পর্যন্ত কী কী পদক্ষেপ নিয়েছেন। আমরা এখন পর্যন্ত বিচারের দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ দেখিনি।'

আন্দোলনে সালাউদ্দিন আম্মার ও মুনতাসির মাহমুদ।
তৃণমূল এনসিপির আহবায়ক ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সংগঠক মুনতাসির মাহমুদ বলেন, 'ওসমান হাদি মৃত্যুর আগেও অনেকবার শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তাকে নানাভাবে হুমকি দেয়া হয়েছে তবুও ওসমান হাদিকে দমাতে পারেনি। ওসমান মৃত্যুর আগেই বলে গেছেন, 'যদি আমাকে মেরেও ফেলে, আপনারা আমার হত্যার বিচার কইরেন'। আমরা আমাদের ভাই, আমাদের সহযোদ্ধা ওসমান হাদির হত্যার বিচার না হওয়া পর্যন্ত রাজপথ ছাড়ব না। এই সরকারের বিভিন্ন স্তরে এখনও ফ্যাসিস্টের বসবাস, এটি হাদিও অনেকবার বলে গেছেন। যেই বিপ্লবীদের অবদানে তারা আজকে ক্ষমতার মসনদে বসে আছেন, এই সরকার তাদেরই নিরাপত্তা দিতে পারেনি।'
তিনি আরও বলেন, 'আমাকেও বিভিন্নভাবে হত্যার হুমকি হুমকি দেয়া হচ্ছে। আমি ইতোমধ্যে থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছি। তবে এসব হুমকি দিয়েও আমাদের দমিয়ে রাখা যাবে না। আমাদের রক্ত শীতল হয়ে যায়নি। আমরা রাজপথে লড়ে যাব, রাজপথই এখন আমাদের ঠিকানা।'
ইনকিলাব মঞ্চের সদস্য সচিব আবদুল্লাহ আল জাবের বলেন, 'হাদি ভাই, আমরা বিচার নিশ্চিত না করে যাব না। আমরা আমাদের অবস্থান জারি রাখব। আমরা খুনিদের বিচার চাই। এর বাইরে আমাদের কোনো চাওয়া নাই। বিচার কার্যক্রম শুরু হলে আমাদের কার্যক্রম আমরা তুলে নেব। তার আগে কোনো আশ্বাসে আমরা কর্মসূচি শেষ করব না।'
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের শনিবার ওসমান হাদির কবর জেয়ারতের কথা রয়েছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ইনকিলাব মঞ্চের ঢাবি শাখার মুখপাত্র ফাতিমা তাসনীম জুমা বলেন, 'বিচার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আমাদের অবস্থান চলবে। বিএনপির নেতা সালাউদ্দিন সাহেবের সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা কালকে আসলে আমরা তাদের যাওয়ার রাস্তা করে দেব। তবে আমাদের কর্মসূচি এখানে বিরতিহীনভাবে চলবে।'
শরিফ ওসমান হাদি হত্যায় খুনিদের গ্রেফতার ও বিচারের দাবিতে শুক্রবার দুপুর ২টা থেকে শুরু হয় আন্দোলন। রাতভর শাহবাগে অবস্থান করার ঘোষণা দিয়েছে ইনকিলাব মঞ্চ।
শরিফ ওসমান হাদি ছিলেন জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে আধিপত্যবাদবিরোধী লড়াইয়ের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র হিসেবে তিনি দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং ফ্যাসিবাদের অবশেষ নির্মূলের দাবিতে রাজপথে ছিলেন আপসহীন। তিনি কেবল একজন সংগঠকই ছিলেন না, বরং তাত্ত্বিক ও নির্ভীক বক্তা হিসেবে তরুণ প্রজন্মের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন।
গত ১২ ডিসেম্বর দুপুরে রাজধানীর বিজয়নগর এলাকায় এক কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার সময় অজ্ঞাত দুর্বৃত্তদের গুলিতে মাথায় গুরুতর জখম হন ওসমান হাদি। সংকটাপন্ন অবস্থায় তাকে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং পরে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য ১৫ ডিসেম্বর তাকে সিঙ্গাপুরে নেওয়া হয়। সেখানে দীর্ঘ ৬ দিন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে অবশেষে ১৮ ডিসেম্বর তিনি শাহাদাতবরণ করেন। তার এই অকাল মৃত্যু সারা দেশের ছাত্র-জনতার মনে গভীর ক্ষোভ ও শোকের জন্ম দিয়েছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



