ছবি: সংগৃহীত
ভারত ভ্রমণে ভিসা জটিলতা, বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনের অফিস কার্যত বন্ধ থাকা এবং ভারতের নতুন অনলাইন নিয়মের কারণে বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ–ভারত যাত্রী যাতায়াত ভয়াবহভাবে কমে গেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে যাত্রী চলাচল প্রায় ৮৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে, যা সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে নজিরবিহীন বলে মনে করছেন বন্দর সংশ্লিষ্টরা।
বেনাপোল ইমিগ্রেশন সূত্র জানায়, গত তিন দিনে মোট ৫ হাজার ৩৯২ জন যাত্রী বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যাতায়াত করেছেন। অথচ কয়েক মাস আগেও প্রতিদিন গড়ে ৭ থেকে ৮ হাজার পাসপোর্টধারী যাত্রী এই বন্দর ব্যবহার করতেন। বর্তমানে সেই সংখ্যা নেমে এসেছে মাত্র ২০ শতাংশে। যাত্রী সংকটে বন্দর এলাকা প্রায় ফাঁকা হয়ে পড়েছে, ক্ষতির মুখে পড়ছে পরিবহন, হোটেল ও স্থানীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো।
ভিসা জটিলতা ও হাইকমিশন বন্ধের প্রভাব
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনের অফিস বন্ধ থাকায় নিয়মিত ভিসা কার্যক্রম কার্যত স্থবির হয়ে গেছে। ভিসার জন্য পাসপোর্ট জমা দিলেও প্রায় ৯৫ শতাংশ আবেদনকারী ভিসা পাচ্ছেন না। সবচেয়ে বড় অভিযোগ হলো—ভিসা না পেলেও আবেদনকারীদের কাছ থেকে নেওয়া ১ হাজার ৫০০ টাকা ভিসা ফি ফেরত দেওয়া হচ্ছে না। এতে সাধারণ যাত্রীদের মধ্যে চরম ক্ষোভ তৈরি হয়েছে।
অনেক ভ্রমণপ্রত্যাশী অভিযোগ করেছেন, বারবার পাসপোর্ট জমা দিয়েও কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই ভিসা আবেদন বাতিল করা হচ্ছে। ফলে চিকিৎসা, ব্যবসা কিংবা শিক্ষার উদ্দেশ্যে যারা ভারতে যেতে চাচ্ছেন, তারা চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছেন।
অনলাইন ‘আগমন ফরম’ বাধ্যতামূলক, বাড়ছে ভোগান্তি
যাত্রী সংকটের আরেকটি বড় কারণ হিসেবে উঠে এসেছে ভারতের নতুন নিয়মে অনলাইন ‘আগমন ফরম’ বাধ্যতামূলক করা। বর্তমানে যাত্রীদের ভারত ভ্রমণের অন্তত ৭২ ঘণ্টা আগে ইন্ডিয়ান ভিসা অনলাইন অ্যারাইভেল ওয়েবসাইটে আগমন ফরম পূরণ করে তার প্রিন্ট কপি সঙ্গে রাখতে হচ্ছে।
যাত্রীরা অভিযোগ করছেন, সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইটের সার্ভার প্রায়ই ডাউন থাকায় ফরম পূরণ করতে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হচ্ছে। আগে ভারতের ইমিগ্রেশনে পৌঁছে হাতে লিখে আগমন ফরম পূরণ করা যেত, কিন্তু নতুন অনলাইন বাধ্যবাধকতায় প্রযুক্তিগত সমস্যার কারণে সাধারণ মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়ছেন।
বেড়েছে ভিসা ও ভ্রমণ ব্যয়
ভিসা জটিলতার পাশাপাশি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে ভ্রমণ ব্যয়। বর্তমানে একজন যাত্রীকে—
-
ভারতীয় দূতাবাসে ভিসা ফি হিসেবে দিতে হচ্ছে ১ হাজার ৫০০ টাকা,
-
ভিসা পাওয়ার পর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ভ্রমণকর বাবদ ১ হাজার ৫৭ টাকা,
-
এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে পোর্ট চার্জ ও অন্যান্য খরচ।
সব মিলিয়ে একজন যাত্রীর খরচ আগের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এতে করে বিশেষ করে চিকিৎসা, ব্যবসা ও শিক্ষার উদ্দেশ্যে যাতায়াতকারী মধ্যবিত্ত ও নিম্নআয়ের মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
মেডিক্যাল ভিসাতেও কড়াকড়ি
ভিসা সংকটের প্রেক্ষাপটে গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে ভারতগামী ভ্রমণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমতে শুরু করে। রাজনৈতিক অস্থিরতার অজুহাতে ভারত সরকার ট্যুরিস্ট, বিজনেস ও স্টুডেন্ট ভিসা বন্ধ রাখে। বর্তমানে কেবল মেডিক্যাল ভিসা চালু থাকলেও তা দেওয়া হচ্ছে অত্যন্ত সীমিত পরিসরে—শর্তসাপেক্ষে মাত্র ৫ শতাংশ রোগীকে।
আরও কঠোর শর্ত আরোপ করা হয়েছে মেডিক্যাল ভিসায়। যে ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেখিয়ে ভিসা নেওয়া হয়েছে, সেই নির্দিষ্ট ডাক্তারের কাছেই চিকিৎসা নিতে হবে। এই শর্ত লঙ্ঘন করলে ফেরার পথে ভারতীয় ইমিগ্রেশনে যাত্রীদের আটকে দেওয়া হচ্ছে, এমন অভিযোগও রয়েছে।
দালালের কাছে জিম্মি যাত্রীরা
ভিসা না পেয়ে অনেক যাত্রী বাধ্য হয়ে দালালের মাধ্যমে আবেদন করছেন। এতে কিছু ক্ষেত্রে ভিসা মিললেও অতিরিক্ত ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা খরচ করতে হচ্ছে। ফলে চিকিৎসার জন্য যারা ভারতে যাচ্ছেন, তাদের বড় অঙ্কের অর্থ ভিসা ও আনুষঙ্গিক খরচেই শেষ হয়ে যাচ্ছে।
ফরিদপুরের বাসিন্দা শ্যামল দত্ত বলেন, “তিনবার ভিসার জন্য পাসপোর্ট জমা দিয়েও ভিসা পাইনি। চতুর্থবার দালালের মাধ্যমে ১০ হাজার টাকা দিয়ে ভিসা পেয়েছি। এর বাইরে ভিসা অফিসে ১ হাজার ৫০০ টাকা, ভ্রমণ কর ১ হাজার ৬০ টাকা দিতে হয়েছে। এত খরচ করার পর ডাক্তারের ফি দেওয়ার মতো টাকাই হাতে থাকছে না।”
পরিসংখ্যানে যাত্রী হ্রাস
বেনাপোল স্থলবন্দর ইমিগ্রেশনের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম শাখাওয়াত হোসেন জানান, গত তিন দিনে—
-
শনিবার ভারতে গেছেন ৮৪৭ জন, ফিরেছেন ৭৭৯ জন,
-
রবিবার গেছেন ৯৭৭ জন, ফিরেছেন ৮৮০ জন,
-
সোমবার গেছেন ১ হাজার ১৩৯ জন, ফিরেছেন ৭৭০ জন।
তিনি বলেন, “ভিসা বন্ধ থাকা, ভিসা দিতে জটিলতা এবং ভারতের নতুন অনলাইন নিয়মের কারণে যাত্রী যাতায়াত অনেকাংশে কমে গেছে।”
সংকটে সাধারণ মানুষ
সব মিলিয়ে ভিসা জটিলতা, অতিরিক্ত খরচ, অনলাইন নিয়মের ভোগান্তি ও দালালনির্ভরতা বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতগামী যাত্রীদের চলাচলকে চরমভাবে সংকুচিত করেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দ্রুত ভিসা প্রক্রিয়া সহজ না হলে এবং অনলাইন ব্যবস্থার সমস্যার সমাধান না হলে এই সংকট আরও গভীর হবে, যার সরাসরি ভুক্তভোগী হবেন সাধারণ মানুষ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



