ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) দেশের সব কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট অফিসে বহিরাগত ও অননুমোদিত ব্যক্তিদের প্রবেশ ও দপ্তরিক কার্যক্রমে সম্পৃক্ততার ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে বন্ড কমিশনারেটের ভেতরে বহিরাগতদের অবাধ চলাচল, ফাইল তদবির ও প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপের একাধিক অভিযোগ পাওয়ার পর এনবিআর এ নির্দেশনা দিয়েছে।
এ বিষয়ে এনবিআরের কাস্টমস রপ্তানি ও বন্ড শাখা থেকে সম্প্রতি সব কমিশনারের কাছে একটি কঠোর নির্দেশনামূলক চিঠি পাঠানো হয়েছে। এনবিআরের সচিব (কাস্টমস: রপ্তানি ও বন্ড) সুরাইয়া সুলতানার স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, “সাম্প্রতিক সময়ে কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট অফিসগুলোতে বহিরাগত ও অননুমোদিত ব্যক্তিদের উপস্থিতি এবং তাদের দপ্তরিক কর্মকাণ্ডে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অংশগ্রহণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যা অত্যন্ত অনভিপ্রেত ও দপ্তরের কর্মপরিবেশ, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ।”
চিঠিতে আরও বলা হয়, অতীতে এনবিআরের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে একাধিকবার নির্দেশনা জারি করা হলেও তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হয়নি। বরং সাম্প্রতিক সময়ে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনৈতিক ঘটনার সঙ্গে বহিরাগতদের সম্পৃক্ততার তথ্য পাওয়া গেছে, যা দপ্তরের ভাবমূর্তি ও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার জন্য উদ্বেগজনক।
এনবিআরের শীর্ষ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বন্ড কমিশনারেটগুলোর দাপ্তরিক কার্যক্রমে শুধুমাত্র অনুমোদিত কর্মকর্তা, কর্মচারী ও বৈধ ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরাই প্রবেশ করতে পারবেন। যেসব ব্যক্তি কোনো সরকারি বা ব্যবসায়িক অনুমোদন ছাড়া অফিসে প্রবেশ করে তদবির, তথ্য সংগ্রহ বা নথিপত্রে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করবে, তাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
চিঠিতে কমিশনারদের উদ্দেশে বলা হয়েছে, “বহিরাগতদের অননুমোদিত প্রবেশ ও দপ্তরিক কাজে সম্পৃক্ততা বন্ধে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। প্রয়োজনে অফিসের প্রবেশপথে নিরাপত্তারক্ষী মোতায়েন, ভিজিটর রেজিস্টার বাধ্যতামূলক করা এবং আইডি কার্ডবিহীন ব্যক্তিদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করতে হবে।”
একই সঙ্গে সতর্ক করা হয়েছে, যদি কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বহিরাগতদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা বা দাপ্তরিক কাজে সহযোগিতার প্রমাণ পাওয়া যায়, তবে তাদের বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ অনুযায়ী কঠোর প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এনবিআর সূত্র জানায়, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ঢাকাসহ চট্টগ্রাম, খুলনা ও কুমিল্লার বন্ড কমিশনারেটগুলোতে বহিরাগতদের ঘন ঘন প্রবেশের অভিযোগ উঠে এসেছে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, নির্দিষ্ট কিছু বন্ড লাইসেন্সধারী বা তাদের প্রতিনিধি পরিচয়ে কিছু ব্যক্তি অফিসের ভেতরে অবস্থান করে কর্মকর্তাদের ওপর প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করছে, যা প্রশাসনিক শৃঙ্খলা নষ্ট করছে এবং ফাঁকফোকর ব্যবহার করে অনৈতিক সুবিধা গ্রহণের সুযোগ তৈরি করছে।
একজন সিনিয়র কাস্টমস কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “বন্ড কমিশনারেটে বহিরাগতদের প্রভাব দীর্ঘদিন ধরেই একটি সমস্যা। অনেক সময় দেখা যায়, অডিট বা তদন্ত চলাকালেও কিছু বহিরাগত ব্যক্তি কর্মকর্তাদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে, যা প্রশাসনিকভাবে একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।”
তিনি আরও বলেন, “এনবিআরের এ নির্দেশনা কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হলে দপ্তরগুলোতে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও নিরাপত্তা বৃদ্ধি পাবে। বহিরাগতদের অনুপ্রবেশ বন্ধ হলে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের কাজ আরও স্বাধীনভাবে করতে পারবেন।”
এনবিআরের কর্মকর্তারা মনে করছেন, কাস্টমস ও বন্ড কমিশনারেটের মতো সংবেদনশীল দপ্তরে বহিরাগতদের উপস্থিতি শুধু প্রশাসনিক ঝুঁকিই নয়, বরং গোপন নথি ফাঁস ও আর্থিক অনিয়মের আশঙ্কাও বাড়ায়। এসব দপ্তরে আমদানি-রপ্তানি ছাড়পত্র, বন্ড সুবিধা, রিফান্ড এবং শুল্ক সংক্রান্ত গোপন তথ্য থাকে—যা অননুমোদিত ব্যক্তিদের হাতে গেলে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
এনবিআর কর্মকর্তাদের মতে, এ নির্দেশনা কার্যকর করতে হলে শুধু চিঠি পাঠানো নয়, বরং মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। কমিশনারদের তদারকি বাড়ানো, অফিসে সিসিটিভি মনিটরিং, এবং প্রবেশপথে কঠোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
সার্বিকভাবে, এনবিআরের নতুন এ উদ্যোগকে কর্মকর্তারা স্বাগত জানালেও, অনেকে মনে করছেন বাস্তবায়নই হবে আসল চ্যালেঞ্জ। কারণ, অতীতেও একই ধরনের নির্দেশনা দেওয়া হলেও তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে কাগজেই সীমাবদ্ধ ছিল।
একজন প্রাক্তন কাস্টমস কমিশনার বলেন, “বন্ড কমিশনারেটের প্রশাসনিক পরিবেশে বহিরাগতদের প্রভাব অনেক পুরনো বিষয়। অনেক সময় রাজনৈতিক বা প্রভাবশালী ব্যবসায়িক সংযোগ ব্যবহার করে তারা অফিসে প্রবেশ করে। এবার যদি এনবিআর সত্যিই কঠোর হয়, তবে এটি কাস্টমস ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনবে।”
এনবিআর বলছে, দপ্তরের ভাবমূর্তি রক্ষা, কর্মপরিবেশ স্বচ্ছ রাখা এবং অনিয়ম-দুর্নীতি রোধে এই নির্দেশনার কঠোর প্রয়োগ এখন সময়ের দাবি। সব কমিশনারেটকে এ নির্দেশনা অবিলম্বে কার্যকর করতে বলা হয়েছে।
বাংলাবার্তা/এসজে
.png)
.png)
.png)



