
ছবি: সংগৃহীত
বরকত—শুধু সম্পদ বা আয়ে নয়, বরং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কল্যাণ, প্রশান্তি ও প্রাচুর্যের প্রতীক। পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছেন যারা দীর্ঘ জীবন পেয়েছেন, কিন্তু সেই জীবনে ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি কিংবা আমল-ইবাদতে কোনো বরকত নেই। আবার দেখা যায়—অনেকেই অক্লান্ত পরিশ্রম করেন, কিন্তু আয়-রোজগারে, মানসিক প্রশান্তিতে বা সামাজিক কল্যাণে প্রাপ্তি খুবই সীমিত। এর মানে তাদের পরিশ্রমে বরকতের ঘাটতি রয়েছে।
অন্যদিকে, এমন মানুষও আছেন যারা অল্প আয় বা কম সময়ের মধ্যেও প্রচুর কল্যাণ ও প্রাচুর্য উপভোগ করেন। হয়তো ব্যবসায় সামান্য মূলধন, চাকরিতে অল্প বেতন—তবু তাদের জীবনে সুখ, শান্তি, সন্তানের সফলতা, দোয়া কবুল হওয়া এবং আল্লাহর রহমত প্রবাহিত হয়। এর মূল রহস্য হলো বরকত। বরকত আল্লাহর বিশেষ নেয়ামত, যা মানুষের পরিশ্রমে প্রাণ সঞ্চার করে এবং অল্পকেও অনেক করে দেয়।
কুরআন ও সুন্নাহ বরকত লাভের বিভিন্ন কার্যকর উপায় শিক্ষা দিয়েছে। নিচে জীবনকে বরকতময় করার কিছু আমল তুলে ধরা হলো—
বেশি বেশি ইসতেগফার করা
বরকত লাভের অন্যতম প্রধান উপায় হলো ইসতেগফার—অর্থাৎ আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা। ইসতেগফারের জন্য নির্দিষ্ট সংখ্যা বা সময় বাধ্যতামূলক নয়; জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে, হাঁটতে-চলতে, কাজ করতে, ঘুমাতে যাওয়ার আগে—যতবার সম্ভব পড়া উচিত: আস্তাগফিরুল্লাহ।
ইসতেগফার পড়ার সময় মনেপ্রাণে অনুভব করা উচিত—আমি আমার সব গুনাহ ও ত্রুটির জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইছি। এই আন্তরিক মনোভাবই আল্লাহর রহমত ও বরকত ডেকে আনে।
কুরআনে নূহ (আ.)-এর মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা ইসতেগফারের অসাধারণ ফলাফল তুলে ধরেছেন— “তোমরা তোমাদের পালনকর্তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো, নিশ্চয় তিনি পরম ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের উপর প্রাচুর্যময় বৃষ্টি বর্ষণ করবেন, ধন-সম্পদ ও সন্তান বৃদ্ধি করবেন, তোমাদের জন্য উদ্যান সৃষ্টি করবেন এবং নদীনালা প্রবাহিত করবেন।” (সুরা নূহ: ১০-১২)
রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “যে ব্যক্তি ইসতেগফার অব্যাহত রাখে, আল্লাহ তাআলা তার জন্য প্রত্যেক সংকট থেকে মুক্তির পথ করে দেবেন এবং দুঃশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দিয়ে এমন জায়গা থেকে রিজিক দেবেন যা সে কল্পনাও করেনি।” (আবু দাউদ)
আল্লাহর ওপর পূর্ণ ভরসা করা
বরকত পাওয়ার আরেকটি মূল চাবিকাঠি হলো তাওয়াক্কুল—অর্থাৎ আল্লাহর ওপর পূর্ণ ভরসা রাখা। কাজের উদ্যোগ নেওয়া অবশ্যই জরুরি, কিন্তু ফলাফলের জন্য আল্লাহর ওপর নির্ভর করাই মুমিনের বৈশিষ্ট্য।
রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “তোমরা যদি আল্লাহর ওপর যথাযথ ভরসা করো, তাহলে তিনি তোমাদের রিজিক দেবেন যেমনটি তিনি পাখিদের দেন—যারা সকালে খালি পেটে বের হয় এবং সন্ধ্যায় পরিপূর্ণ পেটে ফিরে আসে।” (তিরমিযি)
নিয়মিত নামাজ আদায় করা
নামাজ শুধু ফরজ ইবাদত নয়, বরং বরকতের উৎস। নিজে নিয়মিত নামাজ পড়ার পাশাপাশি পরিবারকেও নামাজে অভ্যস্ত করা জরুরি।
আল্লাহ তাআলা বলেন— “আপনি আপনার পরিবারকে নামাজের নির্দেশ দিন এবং নিজেও তা অবিচলভাবে পালন করুন। আমি আপনার কাছে কোনো রিজিক চাই না, আমিই আপনাকে রিজিক দিই।” (সুরা ত্বাহা: ১৩২)
সকালবেলা কাজ শুরু করা
সকালবেলায় কাজ শুরু করলে তাতে বিশেষ বরকত থাকে। রাসুলুল্লাহ ﷺ দোয়া করেছেন— “হে আল্লাহ! আমার উম্মতের সকালবেলায় বরকত দান করুন।” (আবু দাউদ)
তাই ব্যবসা, চাকরি কিংবা ঘরের কাজ—যতটুকুই হোক, দিনের শুরুতেই আল্লাহর নাম নিয়ে শুরু করা উত্তম।
বেশি বেশি দান করা
দান বা সাদকা বরকতের এক অমূল্য মাধ্যম। দানের মাধ্যমে আল্লাহ বিপদ-আপদ দূর করেন এবং রিজিকে প্রশস্ততা দান করেন। রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “তোমরা দান দ্বারা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও, তা অর্ধেক খেজুর দিয়েও হোক।” (বুখারি, মুসলিম)
প্রতিদিন সামর্থ্য অনুযায়ী কিছু দান করা বা দানের জন্য নির্দিষ্ট অংশ আলাদা করে রাখা অভ্যাসে পরিণত করা উচিত।
আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা
সিলাহ্-রাহিম—অর্থাৎ আত্মীয়দের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা জীবনে বরকত ডেকে আনে। এমনকি যদি তারা কটু ব্যবহার করে, তবুও নিজের পক্ষ থেকে সম্পর্ক ভালো রাখা উচিত।
রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “যে আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখবে, তার রিজিক বৃদ্ধি ও আয়ু বৃদ্ধি হবে।” (বুখারি, মুসলিম)
প্রতিটি কাজ বিসমিল্লাহ বলে শুরু করা
বিসমিল্লাহ বলা শুধু ইবাদতে নয়, বরং খাওয়া, ঘরে প্রবেশ, লেখাপড়া—সব কাজে বরকত আনে এবং শয়তানকে দূরে রাখে।
কুরআনের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক রাখা
কুরআন তেলাওয়াত, অর্থ বোঝা এবং জীবন কুরআনের আলোকে সাজানো—এগুলো বরকতের উৎস।
আল্লাহ তাআলা বলেন— “এটি একটি বরকতময় কিতাব, যা আমি অবতীর্ণ করেছি। সুতরাং এর অনুসরণ করো, যাতে তোমরা রহমত প্রাপ্ত হও।” (সুরা আনআম: ১৫৫)
রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন— “আল্লাহ এই কিতাব (কুরআন) দ্বারা অনেক জাতিকে উন্নত করবেন এবং অনেক জাতিকে পতিত করবেন।” (মুসলিম)
সবশেষে বলা যায়—বরকত কেবল পরিশ্রমে আসে না; বরং তা আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ। আর এই অনুগ্রহ লাভের জন্য ইসতেগফার, তাওয়াক্কুল, নামাজ, দান, সিলাহ্-রাহিম, সকালবেলায় কাজ শুরু, বিসমিল্লাহ বলা ও কুরআনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলাই সবচেয়ে কার্যকর উপায়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ