ছবি: সংগৃহীত
বহু বছর ধরে আচরণগত অনিয়ম, বদলি আদেশ অমান্য, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আইনি নির্দেশ অগ্রাহ্য করা এবং দীর্ঘদিন বিনা অনুমতিতে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকার মতো একাধিক গুরুতর অভিযোগ পর্যালোচনার পর বিসিএস (শুল্ক ও আবগারি) ক্যাডারের ২৮তম ব্যাচের কর্মকর্তা মো. লুৎফুল কবিরকে সরকারি চাকরি থেকে চূড়ান্তভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ বৃহস্পতিবার (২০ নভেম্বর) এই বরখাস্ত আদেশ জারি করে, যা রাষ্ট্রপতি কর্তৃক অনুমোদিত। প্রায় আট মাসেরও বেশি সময় ধরে সাময়িক বরখাস্ত অবস্থায় থাকা এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত শেষে দোষ প্রমাণিত হওয়ায় সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে "চাকরি হতে বরখাস্তকরণ" বা চাকরিচ্যুতি কার্যকর করা হয়েছে।
২০২৪ সালের ২৮ অক্টোবর মো. লুৎফুল কবিরকে ঢাকা দক্ষিণ কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট থেকে যশোর কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটে বদলি করা হয়। বদলি আদেশ অনুযায়ী তাঁকে একই দিনে ঢাকা দক্ষিণ ভ্যাট কমিশনারেট থেকে অবমুক্ত করা হয়, যাতে তিনি নতুন কর্মস্থলে যোগদান করতে পারেন। কিন্তু অবমুক্তির পরও তিনি যশোর ভ্যাট কমিশনারেটে যোগদান করেননি। বরং ২৮ অক্টোবর তারিখে ছুটির আবেদন করলেও সেই আবেদনটি তিনি নিয়মবহির্ভূতভাবে অধীনস্থ কর্মচারীর মাধ্যমে ২৭ অক্টোবর ব্যাকডেটে গ্রহণ শাখায় রিসিভ করান। ছুটির আবেদন অনুমোদিত না হওয়া সত্ত্বেও তিনি কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকেন। ফলে তিনি ৬০ দিনেরও বেশি সময় বিনা অনুমতিতে ডিউটি থেকে পালিয়ে ছিলেন।
সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ অনুযায়ী বদলি আদেশ অমান্য করা "অসদাচরণ" এবং অনুমতি ছাড়া দীর্ঘদিন কর্মস্থল ত্যাগ করে থাকার বিষয়টি "পলায়ন" হিসেবে গণ্য হয়। এই দুটি অপরাধের ভিত্তিতেই তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হয়।
এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অতীতেও একাধিকবার অসদাচরণ, সহকর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার এবং সেবাপ্রার্থী নাগরিকদের সঙ্গে খারাপ আচরণের অভিযোগ উঠেছিল। বিশেষ করে ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে পানগাঁও কাস্টম হাউসে রাজস্ব কর্মকর্তাদের সঙ্গে তিনি দুর্ব্যবহার ও হুমকি দেওয়ার অভিযোগে আলোচনায় আসেন। ওই ঘটনার পর দেশজুড়ে সকল কাস্টম হাউস ও ভ্যাট কমিশনারেটে মানববন্ধন, কলম বিরতি ও প্রতিবাদ কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়। সরকারি দপ্তরগুলোর মধ্যে খুব কম সংখ্যক ক্ষেত্রেই কোনো কর্মকর্তার আচরণজনিত কারণে সারাদেশব্যাপী এমন প্রতিবাদ দেখা গেছে।
বদলি আদেশ অমান্য এবং পলায়নের অভিযোগে বিভাগীয় মামলা রুজুর পর অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ তাঁর কাছে কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠায়। তিনি লিখিত জবাব দাখিল করেন এবং ব্যক্তিগত শুনানিরও আবেদন করেন। নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যক্তিগত শুনানি গ্রহণ করা হয়।
তবে তাঁর লিখিত জবাব, শুনানিতে দেওয়া বক্তব্য ও দাখিলকৃত তথ্য-প্রমাণ পর্যালোচনায় অভিযোগ থেকে মুক্ত হওয়ার মতো কোনো সন্তোষজনক যুক্তি পাওয়া যায়নি।
ন্যায়বিচারের স্বার্থে পরবর্তীতে মূসক নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আকবর হোসেনকে (বর্তমানে ব্রাসেলসে কর্মরত) আনুষ্ঠানিক তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ করা হয়। তিনি চলতি বছরের ১৫ জুন তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। ওই প্রতিবেদনে সরকারী কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা অনুযায়ী লুৎফুল কবিরের বিরুদ্ধে আনা "অসদাচরণ" এবং "পলায়ন"—দুটিই সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত বলে মতামত দেওয়া হয়।
এরপর দ্বিতীয়বার কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়ে ৭ কার্যদিবসের মধ্যে জবাব দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। তিনি ২৪ জুলাই সেই নোটিশের জবাব দাখিল করেন। কিন্তু তাঁর জবাবও গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি।
বিধিমালা অনুযায়ী গুরুদণ্ড আরোপের পূর্বে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)-এর মতামত নেওয়া বাধ্যতামূলক। প্রশাসনিক মন্ত্রণালয় পিএসসি-কে মতামতের জন্য অনুরোধ পাঠালে তারা লুৎফুল কবিরকে চাকরি হতে বরখাস্ত করার সিদ্ধান্তকে সঠিক ও উপযুক্ত বলে অভিমত দেয়। এরপর রাষ্ট্রপতি কর্তৃক এ শাস্তি অনুমোদিত হয়।
সব নথি, তদন্ত প্রতিবেদন, পিএসসির মতামত এবং আইনানুগ বিধান পর্যালোচনার ভিত্তিতে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮-এর বিধি ৪(৩) (ঘ) অনুযায়ী গুরুদণ্ড “চাকরি হতে বরখাস্তকরণ” বা চাকরিচ্যুতির আদেশ জারি করে। এ আদেশ জারির ফলে মো. লুৎফুল কবির আর সরকারি চাকরিতে বহাল থাকছেন না এবং সরকারি সেবায় তাঁর অধ্যায়ের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি হয়।
চলমান প্রশাসনিক শুদ্ধি অভিযান, শৃঙ্খলাজনিত সংস্কার উদ্যোগ এবং সরকারি দপ্তরে কর্মচারীদের আচরণগত জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার প্রেক্ষাপটে এই বরখাস্ত সিদ্ধান্তকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
বাংলাবার্তা/এসজে
.png)
.png)
.png)



