
ছবি: সংগৃহীত
এপ্রিল মাসে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের যে প্রস্তাব এসেছে, সেটিকে ‘হঠকারী’, ‘অপরিণামদর্শী’ ও ‘অযৌক্তিক’ হিসেবে উল্লেখ করে তীব্র সমালোচনা করেছেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, ওই সময় বিভিন্ন সামাজিক, ধর্মীয় ও শিক্ষাবিষয়ক বাস্তবতা উপেক্ষা করে নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠবে এবং সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ বাধাগ্রস্ত হবে।
রোববার (৮ জুন) রাজধানীর বিজয়নগরে জাতীয়তাবাদী ভ্যান-রিকশা শ্রমিক দলের পক্ষ থেকে আয়োজিত এক দুস্থদের মধ্যে খাবার বিতরণ অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, এপ্রিল মাসে নির্বাচন দেওয়ার ভাবনা জনগণের কাছে একেবারেই ‘অপরিপক্ব’ বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
বিএনপির এই নেতা বলেন, “ড. মুহাম্মদ ইউনূস যেভাবে বলেছেন যে এপ্রিল মাসের প্রথমার্ধে নির্বাচন হতে পারে, সেই ঘোষণার সময় ও উদ্দেশ্য উভয়দিকেই প্রশ্ন তোলার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। জনগণ এখন প্রশ্ন করছে, নির্বাচনের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের ভিত্তি কী? এটি কি কারও স্বার্থসিদ্ধির জন্য একটি সাজানো পরিকল্পনা?”
তিনি আরও বলেন, “কেন শুধুমাত্র এক-দুজন ব্যক্তি বা বিশেষ রাজনৈতিক গোষ্ঠীর কথায় নির্বাচন আয়োজনের সময় নির্ধারিত হচ্ছে? এর পেছনে কি জনসম্পৃক্ত কোনো মতামত নেওয়া হয়েছে, নাকি এটি আবার একটি একতরফা প্রক্রিয়ার সূচনা?”
রিজভী তাঁর বক্তব্যে ব্যাখ্যা করেন, “বাংলাদেশের এপ্রিল মাসটি একটি ভৌগোলিকভাবে চরম প্রতিকূল সময়। এই সময় প্রচণ্ড তাপদাহ থাকে, ঘূর্ণিঝড়-বৃষ্টির আশঙ্কা থাকে। তার সঙ্গে এবার যুক্ত হচ্ছে পবিত্র রমজান ও ঈদুল ফিতর। সেই সঙ্গে দেশের লাখ লাখ শিক্ষার্থী তখন এসএসসি ও সমমানের পাবলিক পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে।”
তিনি প্রশ্ন রাখেন, “এই সব বাস্তবতা মাথায় রেখেই তো নির্বাচন কমিশনকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কিন্তু যেভাবে বলা হচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে জনগণের জীবনযাত্রা ও জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সময়সূচিকে উপেক্ষা করে রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের প্রয়াস চলছে। এ ধরনের কর্মকাণ্ড গণতান্ত্রিক চর্চাকে বাধাগ্রস্ত করে।”
রিজভী সরকারের সদিচ্ছার অভাব এবং অতীত অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “বাংলাদেশের রাজনীতিতে দেখা গেছে, শেখ মুজিবুর রহমান থেকে শুরু করে শেখ হাসিনা পর্যন্ত ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার প্রবণতা দেখিয়েছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে—তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নামে যে সাম্প্রতিক প্রক্রিয়া গড়ে উঠছে, সেটিও কি ওই একই পথে হাঁটছে না?”
তিনি বলেন, “গণতন্ত্র মানে হচ্ছে জনগণের অংশগ্রহণে সরকার গঠন। অথচ আমরা বারবার দেখি, ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়, নির্বাচনী ব্যবস্থাকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করা হয়। এখন আবার এই তথাকথিত নিরপেক্ষ সরকারের মাধ্যমে যদি আওয়ামী লীগের মতো একদলীয় শাসনের রূপ পুনরায় আসে, তাহলে সেটি হবে জনগণের সঙ্গে আরেকটি প্রতারণা।”
বিএনপির এই মুখপাত্র বলেন, “গত ১৫-১৬ বছরে আওয়ামী লীগ শুধু যে জনগণের অধিকার কেড়ে নিয়েছে, তা নয়—তারা দেশের সকল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে কৌশলে ধ্বংস করে দিয়েছে। সংসদ এখন বিতর্কহীন, প্রশাসন দলীয়ভাবে পরিচালিত হয়, বিচারব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ, নির্বাচন কমিশন জনগণের আস্থা হারিয়েছে।”
রিজভীর অভিযোগ, “একটি রাষ্ট্র কেবল রাজনৈতিক দলের খেয়াল-খুশিতে চলতে পারে না। জনগণ ভোট দেবে, তারা সরকারের কর্মকাণ্ড বিচার করবে। কিন্তু গত কয়েকটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যেভাবে ‘ভোট ছিনতাই’ করেছে, তাতে নির্বাচনের পবিত্রতা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। শেখ হাসিনা সরকার বারবার জনগণের অভিমতের সঙ্গে প্রতারণা করেছে।”
বক্তব্যের একপর্যায়ে রিজভী এপ্রিলের পরিবর্তে ডিসেম্বর মাসে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের দাবি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “বাংলাদেশের আবহাওয়া, শিক্ষা কার্যক্রম, ধর্মীয় কার্যক্রম—সবকিছু বিবেচনায় ডিসেম্বর মাস হচ্ছে সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। তাপমাত্রা সহনীয়, বড় ধরনের উৎসব বা পরীক্ষা থাকে না, মানুষ প্রচারণায় অংশ নিতে পারে।”
তিনি আরও বলেন, “তাদের উদ্দেশ্য যদি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক নির্বাচন হয়, তাহলে কেন একটি সময়োপযোগী এবং অংশগ্রহণমূলক তারিখ বেছে নেওয়া হচ্ছে না? এতে তো বোঝা যায়, পরিকল্পনার ভেতরে অন্য কিছু লুকানো রয়েছে।”
জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নানা ধরনের আলোচনা-সমালোচনার মধ্যেই রিজভীর এই বক্তব্য নতুন করে বিতর্ক উসকে দিয়েছে। বিশেষত, যখন নির্বাচনী সময়সূচি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ চরমে, তখন একজন শীর্ষ বিএনপি নেতার পক্ষ থেকে এপ্রিল মাসের নির্বাচন আয়োজনের বিরুদ্ধে এমন কঠোর বক্তব্য স্পষ্ট করছে যে, বিরোধী দলগুলোর মধ্যে এখনও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে আস্থা তৈরি হয়নি।
রিজভীর মতে, “গণতন্ত্র মানে শুধু নির্বাচন নয়, জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা। আর সেই অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে নির্বাচন হতে হবে অংশগ্রহণমূলক, সময়োপযোগী এবং সর্বোপরি, জনগণের সুবিধা মাথায় রেখে।”
বাংলাবার্তা/এমএইচ