ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও একই দিনে গণভোটের মুখোমুখি দেশ। কিন্তু ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী শরিফ ওসমান হাদি হত্যাকাণ্ড পরবর্তী উত্তাল পরিস্থিতি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং নির্বাচন কমিশন (ইসি)কে চরম চাপে ফেলেছে। এর মধ্যেই তফসিলে ঘোষিত সময়ের কোনো পরিবর্তন না করার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে 'নতুন কৌশল' নির্ধারণে রোববার এক জরুরি উচ্চপর্যায়ের বৈঠক ডেকেছে ইসি। বৈঠকে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর প্রধান, পুলিশ প্রধান (আইজিপি) এবং所有 গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তারা অংশ নেবেন। জুলাই মাসের গণ-অভ্যুত্থানের পর প্রথম এই জাতীয় নির্বাচনের আগে উত্তেজনা প্রশমন ও ভোটারদের আস্থা ফিরিয়ে আনা এই বৈঠকের মূল লক্ষ্য বলে জানা গেছে।
হাদি হত্যা: আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর 'ধারণার বাইরে' বিস্তার
সরকারি ও নির্বাচন কমিশনের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, শরিফ ওসমান হাদির প্রকাশ্য দিবালোক হত্যাকাণ্ড এবং মূল সন্দেহভাজন শুটারের দেশ ছাড়ার ঘটনায় সৃষ্ট ক্ষোভ ও বিক্ষোভ যে масштаব এবং গভীরতা পাবে, তা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পূর্বাভাস ও ধারণার চেয়ে অনেক বেশি। যদিও হাদি হত্যার পর উত্তেজনা বৃদ্ধির সম্ভাবনা সম্পর্কে কিছু তথ্য তাদের হাতে ছিল, কিন্তু সারাদেশে এর প্রভাব এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে এর সৃষ্ট দীর্ঘস্থায়ী অস্থিরতা মূল্যায়নে তারা কিছুটা হিমশিম খেয়েছে। গত কয়েক দিনে ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত নৃশংস ও চাঞ্চল্যকর ঘটনাগুলোও পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। তবে, সরকার ও ইসি আশা করছে, বাহিনীগুলোর তৎপরতায় পরিস্থিতি আগামী কয়েক দিনের মধ্যে নিয়ন্ত্রণে আসবে।
ইসির অনড় অবস্থান: ১২ ফেব্রুয়ারিতেই ভোট, পেছানোর চিন্তা নেই
এই নাজুক পরিস্থিতিতেও নির্বাচনের তারিখ পেছানোর কোনো বিকল্প ভাবনা নেই নির্বাচন কমিশনের। কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ শুক্রবার স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, 'নির্বাচন পেছানোর কোনো সুযোগ নেই। নির্দিষ্ট তারিখেই ভোটগ্রহণ হবে। এজন্য আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করতে হবে।' ইসির কর্মকর্তাদের সাথে আলাপচারিতায় জানা যায়, ১২ ফেব্রুয়ারিতেই ভোটগ্রহণের প্রস্তুতি পুরোদমে এগিয়ে নিচ্ছে কমিশন। তবে, তারা স্বীকার করছেন যে, এর জন্য দ্রুততম সময়ে সারাদেশে ভোটার-বান্ধব ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি।
রোববারের জরুরি বৈঠক: নির্ধারণ হবে চূড়ান্ত রোডম্যাপ
এই লক্ষ্যেই আগামীকাল রোববার ইসি কার্যালয়ে এই অভূতপূর্ব বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছে। বৈঠকে দেশের সামগ্রিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি, নির্বাচনি পরিবেশ উন্নয়নে বাহিনীগুলোর ভূমিকা, সম্ভাব্য ঝুঁকি চিহ্নিতকরণ এবং তা মোকাবিলার কৌশল নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে। বৈঠকের পর সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী প্রধান এবং পুলিশ প্রধান (আইজিপি) যৌথভাবে সংবাদ媒体কে ব্রিফিং করবেন। ইসি আশা করছে, এই ব্রিফিং দেশের সাধারণ মানুষের মাঝে নির্বাচন ও নিরাপত্তা বিষয়ে ছড়িয়ে পড়া নানা ধরনের গুজব ও অনিশ্চয়তা কিছুটা দূর করবে এবং আস্থা সৃষ্টি করবে।
নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, 'নির্বাচনি পরিস্থিতি তৈরিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তারা কাজ করছে। আরও কী ধরনের পদক্ষেপ নিলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে, সেটা নিয়ে বৈঠকে বসতে যাচ্ছি।'
নতুন কৌশল: গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি ও রাজনৈতিক যোগাযোগ
ইসি ও সরকারের পক্ষ থেকে গৃহীত 'নতুন কৌশল'-এর দুটি দিক ফুটে উঠেছে। একদিকে, সম্ভাব্য অস্থিরতা ও সহিংসতার গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ ও পূর্বাভাস ব্যবস্থা জোরদার করা হচ্ছে। দেশজুড়ে ঘটে চলা বিভিন্ন অপ্রীতিকর ঘটনার আগাম তথ্য না পাওয়ার যে দুর্বলতা দেখা গেছে, তা দূর করতে গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং বাহিনীগুলোর সমন্বয় বাড়ানোর উপর জোর দেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে, রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে অনানুষ্ঠানিক কিন্তু কার্যকর যোগাযোগের মাধ্যমে তাদের নেতাকর্মীদের নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার চেষ্টা চলছে। সরকারি মহল মনে করছে, রাজনৈতিক মৈত্রী ও সংলাপের মাধ্যমেই উত্তেজনা অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব।
তফসিলে মাইনর সংশোধন, ভোটের তারিখ অপরিবর্তিত
এদিকে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাথমিক তফসিলে কিছু ভুল-ত্রুটি সংশোধন করেছে ইসি। প্রধান সংশোধনটি এসেছে মনোনয়নপত্র বাছাই সংক্রান্ত আপিল দায়ের ও নিষ্পত্তির সময়সীমায়। আগে আপিল দায়েরের সময়সীমা ছিল ৫ থেকে ১১ জানুয়ারি (সাত দিন)। নির্বাচনি বিধিমালায় এই সময়সীমা পাঁচ দিন (ধারা ১৯) উল্লেখ থাকায়, তফসিলের সেই অংশ সংশোধন করে আপিল দায়েরের সময় ৫ থেকে ৯ জানুয়ারি (পাঁচ দিন) করা হয়েছে। একইভাবে, আপিল নিষ্পত্তির সময় আগে ১২ থেকে ১৮ জানুয়ারি ছিল, এখন তা ১০ থেকে ১৮ জানুয়ারি করা হয়েছে। তবে, ভোটগ্রহণের তারিখ ১২ ফেব্রুয়ারি এবং মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ তারিখ ২৯ ডিসেম্বর অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। এছাড়া, তফসিলের প্রজ্ঞাপন থেকে সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদের রেফারেন্সও বাদ দেওয়া হয়েছে।
আজকের চ্যালেঞ্জ: হাদির জানাজা-দাফন শান্তিপূর্ণ রাখা
সবচেয়ে বর্তমান ও তাৎক্ষণিক চ্যালেঙ্জ হচ্ছে, আজ শনিবার শরিফ ওসমান হাদির জানাজা ও দাফন কাজ সম্পন্ন করা। এই অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে কোনো প্রকার সহিংসতা, বিশৃঙ্খলা বা অপ্রীতিকর ঘটনা যাতে না ঘটে, সেজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্কতা ও প্রস্তুতি নিয়ে মোতায়েন করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলোকেও তাদের সমর্থক ও নেতাকর্মীদের শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। গত বৃহস্পতিবারের তুলনায় শুক্রবার পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলেও, আজকের দিনটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর বলে মূল্যায়ন করছে কর্তৃপক্ষ।
বিশ্লেষকদের দৃষ্টিভঙ্গি: আস্থাই বড় চ্যালেঞ্জ
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. শাহেদুজ্জামান বলেন, "ইসি এবং সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হলো জনগণের আস্থা অর্জন করা। হাদি হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা শুধু একটি রাজনৈতিক হত্যা নয়, এটি নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং ন্যায়বিচার প্রাপ্তির আশার ওপরও প্রশ্ন তোলে। রোববারের বৈঠক এবং সামনের দিনগুলোতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর ভূমিকা কতটা পেশাদার, নিরপেক্ষ ও কার্যকর হতে পারে, সেটাই নির্ধারণ করবে নির্বাচনি পরিবেশ। শুধু বাহিনী মোতায়েন করলেই হবে না, তাদের কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।"
সুশাসন বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ড. তাসনিম সিদ্দিকীর মতে, "তফসিলে অনড় থাকা ইসির দৃঢ়তারই পরিচয়। কিন্তু সেই তফসিল বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন সর্বদলীয় সম্প্রীতি ও সহযোগিতার পরিবেশ। শুধু অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগই নয়, সকল দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে কার্যকর ও বিশ্বাসযোগ্য সংলাপ জরুরি। নইলে, ভোট হতে পারে, কিন্তু তা কাঙ্ক্ষিত গণতান্ত্রিক উৎসবে পরিণত হবে কিনা, সন্দেহ থেকেই যায়।"
জাতীয় এই সংকটময় সময়ে, নির্বাচন কমিশন এবং সরকারের সামনে দুটি সমান্তরাল চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে: একটি হল শরিফ ওসমান হাদি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত দ্রুত শেষ করে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে উত্তেজনা প্রশমন; অন্যটি হল, সকল পক্ষের অংশগ্রহণে একটি শান্তিপূর্ণ, গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরিতে সকলের আস্থা অর্জন। আগামীকালের বৈঠক এবং এর পরবর্তী কার্যক্রমই এই পথের দিকনির্দেশনা ঠিক করবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



