ছবি: সংগৃহীত
দেশজুড়ে ভয়ংকরভাবে বেড়ে উঠছে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড। ঢাকা ও চট্টগ্রাম—দেশের দুই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক অঞ্চলে মাত্র ১০ দিনের ব্যবধানে চারটি হত্যা সংগঠিত হয়েছে, যার প্রতিটিতেই ব্যবহার করা হয়েছে বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র। জনমনে আতঙ্ক তৈরি করা এসব হত্যাকাণ্ডের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনাগুলো হলো পুরান ঢাকায় ১১ নভেম্বর সন্ত্রাসী তারেক সাইদ মামুনকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা এবং চট্টগ্রামে সন্ত্রাসী সরোয়ার হোসেন বাবলাকে খুনের ঘটনা। দু’টি ঘটনাই শহরের ব্যস্ত এলাকায় দিনের আলোয় ঘটেছে—যেখানে সন্ত্রাসীদের হাতে আধুনিক পিস্তল স্পষ্ট দেখা গেছে ভিডিও ফুটেজে।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, সন্ত্রাসীদের কাছে বিপুল পরিমাণ আগ্নেয়াস্ত্রের উপস্থিতি এখন দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুলিশের একাধিক গোয়েন্দা ইউনিটের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দেশে আগ্নেয়াস্ত্রের স্রোত তৈরি হয়েছে দুই উৎস থেকে—(১) গণ-অভ্যুত্থানের সময় লুট হওয়া অস্ত্র, (২) সীমান্ত পথে নতুন করে প্রবেশ করা অস্ত্র।
লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার হয়নি এক-চতুর্থাংশ
পুলিশ সদর দপ্তরের শীর্ষস্থানীয় একটি সূত্র জানায়, গত বছরের গণ-অভ্যুত্থানের সময় সারা দেশের থানা ও কারাগার থেকে মোট পাঁচ হাজার ৭৫০টি অস্ত্র লুট হয়েছিল। এর মধ্যে উদ্ধার করা গেছে চার হাজার ৪০৮টি অস্ত্র। অর্থাৎ, বিপজ্জনক অস্ত্রসহ এক হাজার ৩৪২টি অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি।
উদ্ধারহীন অস্ত্রগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হলো যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত তিনটি লাইট মেশিনগান (এলএমজি)। পদাতিক বাহিনীর জন্য তৈরি এই অস্ত্র তিনটি কাদের কাছে আছে তা শনাক্ত করতে না পারায় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো গভীর উদ্বেগে রয়েছে। সরকার ইতোমধ্যে অস্ত্রগুলোর সন্ধানদাতাকে পাঁচ লাখ টাকা করে পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে, কিন্তু এখনো কোনো কার্যকর তথ্য পাওয়া যায়নি।
এর পাশাপাশি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশত্যাগের দিন—গত ৫ আগস্ট—গণভবন, সংসদ ভবনসহ চারটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় নিরাপত্তায় থাকা এসএসএফ-এর ৩২টি অস্ত্র লুট হয়। এসব অস্ত্রের মধ্যে ছিল এসএমজি, অ্যাসল্ট রাইফেল, স্নাইপার রাইফেল এবং এলএমজি। অত্যন্ত প্রশিক্ষণ ছাড়া এসব অস্ত্র ব্যবহার করা অসম্ভব—তবুও অস্ত্রগুলো উদ্ধার না হওয়ায় উদ্বেগ বাড়ছে বহুগুণে।
আইজিপি বাহারুল আলম বলেন, “অস্ত্র উদ্ধারে নিয়মিত অভিযান চলছে। উদ্ধারও হয়েছে অনেক। তবে উদ্বেগের বিষয়—মারাত্মক আগ্নেয়াস্ত্র এখনো কোথাও ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কিন্তু সেগুলো কোথায় আছে তা উদ্ঘাটনে কাজ চলছে।”
১৮ সীমান্ত দিয়ে অস্ত্র ঢোকানোর প্রমাণ
গোয়েন্দা একাধিক সংস্থা নিশ্চিত করেছে যে অন্তত ১৮টি সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র ঢুকছে। এই রুটগুলো দিয়ে অস্ত্র পাচারের নেটওয়ার্ক সক্রিয় রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে, তবে নির্বাচনের আগে তাদের কার্যক্রম আরও বেড়েছে।
বিজিবি সূত্র জানিয়েছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সাতক্ষীরা, যশোর, কুমিল্লা, কক্সবাজার—এই সীমান্তপথগুলো সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। এছাড়া দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের পাহাড়ি অঞ্চল এবং সমুদ্রপথ ব্যবহার করেও আগ্নেয়াস্ত্র আনা হচ্ছে। পাচারকারীরা সাধারণত মসলা, ফল, ভেষজ সামগ্রী কিংবা ইলেকট্রনিক পণ্যের প্যাকেটে ছোট আকারের পিস্তল ও রিভলভার লুকিয়ে দেশে প্রবেশ করায়।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তের দায়িত্বে থাকা বিজিবি-৫৯ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল গোলাম কিবরিয়া জানান, “অবৈধ অস্ত্র যাতে ঢুকতে না পারে, সে জন্য সীমান্তে দিনরাত নজরদারি চলছে। নাইটভিশন গগলস, বাইনোকুলারসহ সব ধরনের আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “সীমান্তে কড়া নজরদারি বজায় রেখেও পাচারকারীরা নতুন পদ্ধতি ব্যবহার করছে, যা চ্যালেঞ্জ বাড়াচ্ছে।”
গোয়েন্দা সূত্র বলছে, কঠোর নজরদারির মধ্যেও ৬০ শতাংশ অস্ত্র ধরা পড়ে না। বিজিবির উদ্ধার করা অস্ত্রের পরিসংখ্যান থেকেই বোঝা যায়—দেশের ভেতরে প্রবেশ করা অস্ত্রের পরিমাণ আশঙ্কাজনক।
শুধু অক্টোবর মাসেই বিজিবি উদ্ধার করেছে—
-
চারটি পিস্তল
-
একটি রিভলভার
-
তিনটি মর্টার শেল
-
ছয়টি হ্যান্ড গ্রেনেড
-
তিনটি ম্যাগাজিন
-
৫৩ রাউন্ড গুলি
-
২৫০ গ্রাম বিস্ফোরক
-
দুটি ডেটোনেটর
-
সাতটি বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র
গোয়েন্দাদের মতে, উদ্ধার হওয়া অস্ত্র মোট অস্ত্র পাচারের মাত্র ৪০ শতাংশ। অর্থাৎ, ৬০ শতাংশ দেশে ঢুকে যাচ্ছে অদৃশ্যভাবে।
বিভিন্ন বাহিনীর নজিরবিহীন অভিযান চলছে
অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও পাচার নেটওয়ার্ক ভাঙতে সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাব সারা দেশে যৌথ অভিযান জোরদার করেছে।
-
২৬ অক্টোবর: শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর রেলস্টেশনে সেনাবাহিনী আটটি বিদেশি পিস্তল ও বিস্ফোরক জব্দ করে—গ্রেপ্তার ৪।
-
৩০ অক্টোবর: চট্টগ্রামের রাউজানে এক রাজনৈতিক নেতার বাড়ি থেকে র্যাব উদ্ধার করে ১০টি বন্দুক, অ্যারগান, ১৫টি কিরিচ, চারটি রামদা, ১১টি কার্তুজ, চাইনিজ কুড়াল, লাঠি, আতশবাজি ও মাদক।
-
৩০ অক্টোবর রাত: আশুলিয়ার গাজীরচট এলাকায় যৌথ বাহিনী উদ্ধার করে একটি বিদেশি পিস্তল, দুটি ম্যাগাজিন, ৩৩ রাউন্ড কার্তুজ, চারটি দেশীয় অস্ত্র ও মাদক।
-
সাম্প্রতিক: নরসিংদীর রায়পুরায় র্যাব ১১টি আগ্নেয়াস্ত্রসহ আটক করেছে ৮ জনকে।
নির্বাচনের আগে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার উদ্বেগ বাড়াচ্ছে
দেশব্যাপী একের পর এক হত্যাকাণ্ডে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার গোয়েন্দাদের উদ্বেগ আরও বাড়িয়েছে।
-
৫ নভেম্বর: চট্টগ্রাম শহরে সরোয়ার হোসেন বাবলাকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা—আহত বিএনপি প্রার্থী এরশাদ উল্লাহ।
-
১১ নভেম্বর: পুরান ঢাকায় তারেক সাইদ মামুনকে প্রকাশ্যে হত্যা—ভিডিওতে দেখা যায় দুই হামলাকারীর হাতে পিস্তল।
-
৮ নভেম্বর: রাঙ্গুনিয়ায় আবদুল মান্নানকে গুলি করে হত্যা।
-
১৬ নভেম্বর: লক্ষ্মীপুরে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিএনপি নেতা আবুল কালাম জহিরকে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা।
পরিবারের দাবি—এ হত্যাকাণ্ডে কুখ্যাত সন্ত্রাসী “পিচ্চি কাউছার” জড়িত।
সন্ত্রাসীদের কাছে এত অস্ত্র কীভাবে?
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন—যুদ্ধাস্ত্র থেকে পিস্তল পর্যন্ত বিভিন্ন অস্ত্র এখন বাজারে পাওয়া যাচ্ছে পাচারকারীদের মাধ্যমে। সংগঠিত চক্রগুলো সীমান্তের দুর্বলতা, দুর্নীতিগ্রস্ত কিছু কর্মকর্তা এবং স্থানীয় দালালদের ব্যবহার করে অস্ত্র নিয়ে আসছে। পাচার হওয়া অস্ত্রের অনেকটাই রাজনৈতিক দলে ব্যবহৃত অপরাধী গোষ্ঠী এবং চাঁদাবাজ গ্রুপগুলোর হাতে যাচ্ছে।
দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি কোথায় যাচ্ছে?
একদিকে গণ-অভ্যুত্থানের সময় লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার না হওয়া, অন্যদিকে নতুন অস্ত্রের অবাধ প্রবেশ—দুটি কারণ মিলেই দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে।
গোয়েন্দাদের মতে— “যে গতিতে অস্ত্র ঢুকছে, তাতে নির্বাচনের আগে অস্ত্র-নির্ভর রাজনৈতিক সংঘাতে বড় ধরনের সহিংসতা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে।”
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে থাকলেও অস্ত্র প্রবেশ ও ব্যবহারের ঘটনাগুলো বর্তমান পরিস্থিতির ভয়াবহ বাস্তবতা তুলে ধরছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



