ছবি: সংগৃহীত
বিশ্বজুড়ে সংঘাত, ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা, আঞ্চলিক যুদ্ধ, সামরিক বিভাজন এবং প্রতিরক্ষা ব্যয় বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে বৈশ্বিক অস্ত্রবাজারে যে অস্বাভাবিক উত্থান দেখা যাচ্ছে, তা ইতিহাসে নজিরবিহীন। আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (সিপরি) সোমবার প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদনে জানিয়েছে—২০২৪ সালে বিশ্বের শীর্ষ ১০০ অস্ত্র উৎপাদনকারী কম্পানির সম্মিলিত আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৭৯ বিলিয়ন ডলার, যা এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ। গত বছরের তুলনায় এ আয় বেড়েছে উল্লেখযোগ্য ৫ দশমিক ৯ শতাংশ। বিশ্বের বহু অঞ্চলে চলমান যুদ্ধ, বিশেষ করে ইউক্রেন যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল-গাজা সংঘাত, এবং নানা দেশের প্রতিরক্ষা খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির ফলেই এই বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি ঘটেছে।
বিশ্বব্যাপী অস্ত্রচাহিদা কেন এত দ্রুত বাড়ছে
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিক সংঘাতের মানচিত্র ক্রমেই জটিল হচ্ছে, এবং নতুন নতুন সামরিক জোট গঠনের প্রবণতা বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র-চীন প্রতিদ্বন্দ্বিতা, ন্যাটোর পরিধি বৃদ্ধি, রাশিয়ার আগ্রাসন, মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনা, এবং দক্ষিণ এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সামরিক অবস্থানকে কেন্দ্র করে দেশগুলো ব্যাপক হারে সামরিক সরঞ্জাম সংগ্রহ করছে। এসব কারণে সামরিক ব্যয় বাড়াচ্ছে পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি বড় অর্থনীতি, এবং সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহের চাহিদা পূরণের জন্য অস্ত্র প্রস্তুতকারকরাও উৎপাদন বাড়াচ্ছে।
এই প্রবণতা অধিক মাত্রায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে দেখা গেলেও এর প্রভাব পড়েছে এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও ওশেনিয়া অঞ্চলেও।
যুক্তরাষ্ট্র: প্রবৃদ্ধির কেন্দ্রে বিশ্বের বৃহত্তম উৎপাদনকারী দেশ
শীর্ষ ১০০ কম্পানির মধ্যে ৩৯টি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক। এর মধ্যে ৩০টি গত বছরে আয় বৃদ্ধির কথা জানিয়েছে। তাদের সম্মিলিত আয় দাঁড়িয়েছে ৩৩৪ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ৩ দশমিক ৮ শতাংশ বেশি।
বিশেষত লকহিড মার্টিন, নর্থরপ গ্রুম্যান, বোয়িং, রেথিয়ন টেকনোলজিস এবং জেনারেল ডায়নামিকস এখনো বিশ্বের শীর্ষ অস্ত্র বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে অবস্থান ধরে রেখেছে। এদের তৈরি এফ–৩৫ যুদ্ধবিমান, থাড ও প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, ড্রোন, নৌযান, এবং অন্যান্য উন্নত সামরিক প্রযুক্তি বহু দেশ ব্যাপকভাবে কিনছে।
তবে সিপরি উল্লেখ করেছে—বৃহৎ প্রতিরক্ষা প্রকল্পগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র গুরুতর সমস্যার মুখোমুখি। উদাহরণস্বরূপ, এফ–৩৫ উৎপাদন প্রকল্পে দীর্ঘ বিলম্ব, ব্যয় বাড়তি হওয়া, অংশ উৎপাদনে জটিলতা এবং বিভিন্ন টেকনিক্যাল সমস্যার কারণে যুক্তরাষ্ট্রকে সময় ও অর্থ উভয়ক্ষেত্রেই চাপে ফেলেছে। এসব কারণে অনেক দেশের অর্ডার ডেলিভারি পিছিয়ে যাচ্ছে।
ইউরোপ: রাশিয়ার হুমকিতে ক্রমবর্ধমান সামরিক প্রস্তুতি
ইউরোপের প্রতিরক্ষা শিল্প গত বছরের তুলনায় বড় ধরনের প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। রাশিয়া বাদে ইউরোপের শীর্ষ ২৬টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২৩টি আয় বৃদ্ধির কথা জানিয়েছে। তাদের সম্মিলিত আয় বেড়ে ১৫১ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে—১৩ শতাংশ বৃদ্ধি।
ইউক্রেন যুদ্ধের দীর্ঘায়িত পরিস্থিতিতে ইউরোপের সামরিক বাজেট কয়েক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। ন্যাটো সদস্য দেশগুলো প্রতিরক্ষা ব্যয় জিডিপির ২ শতাংশে উন্নীত করার উদ্যোগ নেওয়ায় ইউরোপীয় অস্ত্রশিল্পে নতুন মেগা-অর্ডার যুক্ত হচ্ছে।
এই প্রবৃদ্ধির মধ্যে সবচেয়ে চমকপ্রদ সাফল্য দেখিয়েছে চেক প্রজাতন্ত্রের চেকোস্লোভাক গ্রুপ—যাদের আয় বেড়েছে অবিশ্বাস্য ১৯৩ শতাংশ। এর অন্যতম কারণ ইউক্রেনের কামানের গোলা সংগ্রহে বৃহৎ সরকারি উদ্যোগ। এছাড়া ইউক্রেনের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিরক্ষা প্রতিষ্ঠান জেএসসি ইউক্রেনিয়ান ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রির আয়ও ৪১ শতাংশ বেড়েছে।
তবে সিপরি সতর্ক করে জানায়—ইউরোপের নতুন উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানো হলেও ভবিষ্যতে সরবরাহ শৃঙ্খল, বিশেষত খনিজ ও যন্ত্রাংশ সরবরাহে বড় বাধার সৃষ্টি হতে পারে। চীন থেকে খনিজ সরবরাহ কমে যাওয়ার ঝুঁকি, রপ্তানি সীমাবদ্ধতা এবং মূল্যবৃদ্ধি পরিস্থিতিকে আরও জটিল করতে পারে।
রাশিয়া: নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও আয়ের রেকর্ড বৃদ্ধি
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা শিল্প যন্ত্রাংশ সংকট, আন্তর্জাতিক বাজার হারানো ও প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার মুখোমুখি হলেও অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়ায় তাদের আয় উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।
সিপরি জানায়—তাদের তালিকাভুক্ত রাশিয়ার দুই প্রধান প্রতিষ্ঠান রোস্তেক এবং ইউনাইটেড শিপবিল্ডিং করপোরেশন গত বছর অস্ত্র বিক্রি থেকে আয় ২৩ শতাংশ বাড়িয়ে মোট ৩১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করেছে।
রাশিয়ায় সামরিক বাহিনীর চাহিদা এতটাই বেড়েছে যে রপ্তানি কমলেও আয়ের ঘাটতি পূরণ হচ্ছে। তবে দক্ষ শ্রমিকের ঘাটতি এবং প্রযুক্তি আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা রাশিয়ার প্রতিরক্ষা শিল্পকে বড় সংকটে ফেলেছে
মধ্যপ্রাচ্য: ইসরায়েলের অস্ত্র রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি
মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং দেশগুলোর সামরিক ব্যয় বৃদ্ধির কারণে এই অঞ্চলও শক্তিশালী প্রবৃদ্ধির মুখ দেখেছে।
ইসরায়েলের তিনটি বড় কম্পানির সম্মিলিত আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারে—প্রবৃদ্ধি ১৬ শতাংশ। গাজায় ইসরায়েলের কর্মকাণ্ড নিয়ে আন্তর্জাতিক সমালোচনা থাকলেও সিপরি বলছে—ইসরায়েলি অস্ত্রের প্রতি বৈশ্বিক আগ্রহে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি। বরং বহু দেশ নতুন অর্ডার দিয়েছে।
রাডার প্রযুক্তি, আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, ড্রোন, সাইবার নিরাপত্তা সরঞ্জাম—ইসরায়েলি এসব পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজার দিন দিনই বাড়ছে।
এশিয়া ও ওশেনিয়া: চীনের সমস্যায় সামান্য পতন
বিশ্বের অন্যতম বড় অস্ত্র প্রস্তুতকারক অঞ্চল হওয়া সত্ত্বেও এশিয়া ও ওশেনিয়ার মোট আয় গত বছর ১ দশমিক ২ শতাংশ কমে ১৩০ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। পতনের মূল কারণ—চীনের প্রতিরক্ষা শিল্পে ১০ শতাংশ আয়ের হ্রাস।
চীনের প্রতিরক্ষা ক্রয় প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় বড় বড় চুক্তি বাতিল বা স্থগিত হয়। দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের কারণে চীনের অভ্যন্তরীণ সামরিক শিল্পে অনিশ্চয়তা দেখা দেয় এবং এর ফলে উৎপাদন ও চুক্তি উভয়ই কমে যায়।
বিশ্বজুড়ে অস্ত্রবাজারে ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি
সিপরির গবেষকরা মনে করছেন, বিশ্বব্যাপী সংঘাত আরও দীর্ঘায়িত হলে আগামী বছরগুলোতেও অস্ত্রবাজারে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। বিশেষত—
-
যুক্তরাষ্ট্র–চীন প্রতিযোগিতা
-
রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধে সম্ভাব্য নতুন পর্যায়
-
মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিতিশীলতা
-
আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকায় নতুন সংঘাত
এগুলো প্রতিরক্ষা ব্যয়কে আরও বাড়াবে, ফলে অস্ত্র বিক্রি ইতিহাসের আরও নতুন রেকর্ড স্পর্শ করতে পারে।
বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা যত বাড়ছে, অস্ত্র উৎপাদনকারী কম্পানিগুলো তত বেশি লাভবান হচ্ছে—এমনটাই তুলে ধরেছে সর্বশেষ সিপরি প্রতিবেদন। অন্যদিকে মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, সামরিক ব্যয় বৃদ্ধির এই প্রবণতা পরোক্ষভাবে সংঘাত বাড়াচ্ছে এবং বিশ্বকে আরও অস্থিতিশীল করছে।
এখন বিশ্বের নজর—এই ক্রমবর্ধমান প্রতিরক্ষা ব্যয় মানবসমাজের ভবিষ্যৎকে কোথায় নিয়ে যাবে?
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



