ছবি: সংগৃহীত
বেনাপোল স্থলবন্দর ও কাস্টমস হাউজকে ঘিরে দুই রাজস্ব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সীমাহীন দুর্নীতি, ঘুষ বাণিজ্য ও ব্যবসায়ীদের জিম্মি করার গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। এসব অভিযোগে বেনাপোলের আমদানিকারক, সিএন্ডএফ এজেন্ট ও স্থানীয় ব্যবসায়ীরা চরম ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেছেন। তাদের দাবি, কয়েকজন কর্মকর্তার ব্যক্তিগত লোভ ও অনিয়মের কারণে দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দরগুলোর একটি কার্যত অচল হয়ে পড়ছে, রাজস্ব আদায় ব্যাহত হচ্ছে এবং আমদানিকারকরা বাধ্য হয়ে অন্য বন্দরের দিকে ঝুঁকছেন।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগের কেন্দ্রে রয়েছেন বেনাপোল কাস্টমস হাউজের পরীক্ষণ গ্রুপ–৩–এর দায়িত্বপ্রাপ্ত রাজস্ব কর্মকর্তা উদ্ভব চন্দ্র পাল। তার সঙ্গে অনিয়মে সহযোগিতার অভিযোগ উঠেছে প্রশাসনিক রাজস্ব কর্মকর্তা (সুপার) শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধেও। অভিযোগ অনুযায়ী, এই দু’জনের সমন্বিত কর্মকাণ্ডে আমদানিকৃত পণ্য খালাসে ইচ্ছাকৃত জটিলতা সৃষ্টি করা হচ্ছে, ফাইল আটকে রাখা হচ্ছে এবং নির্ধারিত নিয়মের বাইরে গিয়ে বিপুল অঙ্কের উৎকোচ আদায় করা হচ্ছে।
ব্যবসায়ীরা জানান, উদ্ভব চন্দ্র পাল দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই পরীক্ষণ গ্রুপ–৩–এ অস্বাভাবিক হয়রানি বেড়েছে। ফাইলপ্রতি নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা না দিলে তিনি স্বাক্ষর করেন না বলে অভিযোগ। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে তিনি মালামাল পরীক্ষণেও যান না। আবার পরীক্ষণে গেলে ‘এটা ঠিক নয়’, ‘ওটা হবে না’, ‘নিয়ম ভেঙেছে’—এ ধরনের নানা অজুহাত দেখিয়ে ফাইল ঝুলিয়ে রাখা হয়। এতে আমদানিকারকরা সময় ও অর্থ—দুই দিক থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
ব্যবসায়ীদের আরও অভিযোগ, প্রশাসনিক রাজস্ব কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম শুল্কায়ন গ্রুপ–৪–এর দায়িত্বে থাকলেও সেখানে নিয়মিত দায়িত্ব পালন করেন না। অফিস সময়ের বড় একটি অংশ তিনি পরীক্ষণ গ্রুপ–৩–এর রাজস্ব কর্মকর্তা উদ্ভব চন্দ্র পালের সঙ্গে সমন্বয় করে অনিয়ম ও ঘুষ আদায়ে ব্যয় করেন। এর ফলে শুল্কায়ন গ্রুপ–৪–এর কাজেও মারাত্মক ধীরগতি দেখা দিয়েছে এবং সামগ্রিকভাবে বন্দরের বাণিজ্যিক কার্যক্রমে স্থবিরতা তৈরি হয়েছে।
পচনশীল পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ বলে জানান ব্যবসায়ীরা। নিয়ম অনুযায়ী, পচনশীল পণ্য ভারতীয় ট্রাক থেকে বাংলাদেশি ট্রাকে খালাসের ক্ষেত্রে কমিশনারের কাছে আবেদন করা হয় এবং দ্রুত ছাড় দেওয়া হয়। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, উদ্ভব চন্দ্র পাল ভারতীয় ট্রাক থেকে বাংলাদেশি ট্রাকে পণ্য খালাস করতে হলে ট্রাকপ্রতি ১০ হাজার টাকা দাবি করছেন। এই টাকা না দিলে খালাস আটকে রাখা হয়, যার ফলে পণ্য নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয় এবং ব্যবসায়ীরা চরম আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েন।
ব্যবসায়ীরা বলেন, এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে কোনো কর্মকর্তা প্রতিবাদ করলে বা প্রশ্ন তুললে তাকে বদলির ভয় দেখানো হয়। অভিযোগ রয়েছে, প্রশাসনিক সুপার শফিকুল ইসলামের পরামর্শে কমিশনারের কাছে মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অন্যত্র বদলি করার হুমকি দেওয়া হয়। ফলে অনেকেই মুখ খুলতে সাহস পান না।
এর প্রভাব সরাসরি পড়ছে বেনাপোল বন্দরের আমদানি কার্যক্রমে। আগে যেখানে প্রতিদিন ৫০ থেকে ৭০টি ট্রাকে কাঁচামাল ও ফলজাতীয় পণ্য আমদানি হতো, এখন সেখানে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১০ থেকে ১৫ ট্রাকে। বহু আমদানিকারক বাধ্য হয়ে সাতক্ষীরার ভোমরা বন্দরসহ অন্য বিকল্প বন্দরের দিকে চলে যাচ্ছেন।
বাগেরহাটের পান ব্যবসায়ী সরাফত ইসলাম বলেন, গত আট বছর ধরে তিনি বেনাপোল বন্দর দিয়ে পান আমদানি করে আসছেন। এই পান বাগেরহাট, খুলনা ও আশপাশের জেলাগুলোতে সরবরাহ করা হয়। কিন্তু বর্তমানে কাস্টমসের কিছু কর্মকর্তার হয়রানির কারণে তিনি বেনাপোল দিয়ে পান আমদানি বন্ধ করে দিয়েছেন। তার ভাষায়, “এক গাড়ি পান আমদানি করে সর্বোচ্চ ১০–১৫ হাজার টাকা লাভ থাকে। সেখানে যদি কাস্টমস কর্মকর্তা গাড়ি প্রতি ১০ হাজার টাকা দাবি করেন, তাহলে ব্যবসা চালানো অসম্ভব।”
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনাপোলের এক সিএন্ডএফ প্রতিনিধি জানান, কাঁচামাল আমদানিকারকদের ওপর সবচেয়ে বেশি চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। পরীক্ষণ গ্রুপ–৩–এ কাঁচামাল এলেই নানা অজুহাতে হয়রানি করা হয় এবং মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করা হয়। টাকা না দিলে ফাইল আটকে রাখা হয়। আবার টাকা দিলে আমদানিকৃত পণ্যে অনিয়ম করতে বাধ্য করা হয়, যা ভবিষ্যতে আরও বড় ঝুঁকি তৈরি করে।
আরও অভিযোগ রয়েছে, গত এক মাসে পরীক্ষণ গ্রুপ–৩–এর মাধ্যমে প্রায় ২৫ জন সিএন্ডএফ ব্যবসায়ীর কাছ থেকে আনুমানিক ৩০ লাখ টাকার বেশি উৎকোচ আদায় করা হয়েছে। এসব টাকা আদায়ে উদ্ভব চন্দ্র পালের নিজস্ব দু’জন লোক কাজ করছে বলে ব্যবসায়ীদের দাবি। তারা হলেন ফল ব্যবসায়ী শামিমের কর্মচারী তৌহিদ ও জিয়া। অভিযোগ অনুযায়ী, আদায়কৃত ঘুষের অর্থের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ প্রশাসনিক সুপার শফিকুল ইসলামকে দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে রাজস্ব কর্মকর্তা উদ্ভব চন্দ্র পালের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি সব অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, “আমি কোনো ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ঘুষ নেই না। আপনারা চাইলে রিপোর্ট করতে পারেন, এতে আমার কিছু আসে যায় না।” তবে ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, তার এমন বক্তব্যই প্রমাণ করে তিনি কতটা প্রভাবশালী ও বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন।
এদিকে বেনাপোলের সিএন্ডএফ এজেন্টদের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, তারা একাধিকবার পরীক্ষণ গ্রুপ–৩ ও শুল্কায়ন গ্রুপ–৪–এর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিত ও মৌখিকভাবে জানিয়েছেন। কিন্তু আশ্বাস ছাড়া কার্যকর কোনো ব্যবস্থা এখনো দেখা যায়নি। তার মতে, “যে কর্মকর্তা রাজস্ব আদায়ে বাধা সৃষ্টি করেন এবং সরকারের ক্ষতি করেন, তাকে দ্রুত অপসারণ করা উচিত।”
এ বিষয়ে বেনাপোল কাস্টমস হাউজের কমিশনার আবু হোসেন মোহাম্মদ খালিদ বলেন, বিষয়টি তিনি খতিয়ে দেখছেন। অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, বেনাপোল কাস্টমসে স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। শতভাগ স্বচ্ছতা হয়তো সম্ভব নয়, তবে তিনি সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন। কমিশনারের দাবি, আমদানি কিছুটা কমলেও বর্তমানে কাজের গতি আগের তুলনায় বেড়েছে।
তবে ব্যবসায়ীদের মতে, কাগজে-কলমে আশ্বাস নয়, দৃশ্যমান পদক্ষেপই পারে বেনাপোল কাস্টমসের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনতে। অন্যথায়, কয়েকজন কর্মকর্তার দুর্নীতির বোঝা বইতে গিয়ে দেশের রাজস্ব, বন্দর ও ব্যবসা—সবই ক্ষতির মুখে পড়বে।
বাংলাবার্তা/এসজে
.png)
.png)
.png)



