ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক দীর্ঘ, ঘটনাবহুল ও সংগ্রামী অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটেছে। দেশের জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, তিনবারের প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া আজ মঙ্গলবার, ৩০ ডিসেম্বর রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তিকাল করেছেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তার ইন্তিকালে দেশের রাজনীতিতে নেমে এসেছে গভীর শোকের ছায়া।
১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট ভারতের জলপাইগুড়িতে জন্মগ্রহণ করেন বেগম খালেদা জিয়া। পারিবারিক ও ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন সাধারণ এক গৃহবধূ। ১৯৬০ সালে কলেজপড়ুয়া অবস্থায় তার বিয়ে হয় তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাডেট অফিসার জিয়াউর রহমানের সঙ্গে। তখনো তার জীবনে রাজনীতির কোনো প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা ছিল না।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় দীর্ঘ নয় মাস দুই সন্তানসহ তিনি গৃহবন্দি অবস্থায় দিন কাটান। স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্র পরিচালনার সঙ্গে সম্পৃক্ত হন এবং পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন। ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হন।
এই আকস্মিক হত্যাকাণ্ডের সময় বেগম খালেদা জিয়া ছিলেন ঢাকার সেনানিবাসে অবস্থানরত একজন সাধারণ গৃহবধূ। স্বামী হত্যার শোক, দুই সন্তানকে নিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ—সব মিলিয়ে তার সামনে তখন ছিল চরম সংকট। একই সঙ্গে রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপিও পড়ে যায় নেতৃত্বশূন্যতায়। কে দলকে নেতৃত্ব দেবেন, কীভাবে দল টিকে থাকবে—এসব প্রশ্নে দিশাহারা হয়ে পড়ে বিএনপি।
এই প্রেক্ষাপটেই রাজনীতির মঞ্চে আবির্ভাব ঘটে খালেদা জিয়ার। ১৯৮২ সালের ২ জানুয়ারি তিনি বিএনপির প্রাথমিক সদস্য হিসেবে দলে যোগ দেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি তার দৃঢ়তা, বক্তব্য ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার কারণে দলের নেতাকর্মীদের আস্থা অর্জন করেন। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৮৩ সালের মার্চ মাসে তিনি বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
১৯৮২ সালের ৮ জানুয়ারি এক বিবৃতিতে খালেদা জিয়া বলেন, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে শোষণহীন, দুর্নীতিমুক্ত ও আত্মনির্ভরশীল রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্য নিয়ে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। দলের ঐক্য ও সংহতি রক্ষার স্বার্থেই তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। শহীদ জিয়ার আদর্শ বাস্তবায়ন ও দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখাই তার মূল লক্ষ্য—এ কথা তিনি স্পষ্ট করে জানান।
বিচারপতি আব্দুস সাত্তার অসুস্থ হয়ে পড়লে ১৯৮৪ সালের ১২ জানুয়ারি খালেদা জিয়া বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসনের দায়িত্ব পান। একই বছরের ১০ মে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দলের চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৯৩, ২০০৯ ও ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত বিএনপির জাতীয় কাউন্সিলগুলোতে তিনি বারবার দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বে পুনর্নির্বাচিত হন।
দলের নেতৃত্ব গ্রহণের পরপরই তাকে মোকাবিলা করতে হয় সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের স্বৈরশাসন। কোনো ধরনের আপস না করে তিনি এরশাদবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। ১৯৮৭ সাল থেকে ‘এরশাদ হটাও’ এক দফা আন্দোলনের ডাক দিয়ে তিনি রাজপথে সক্রিয় হন। একের পর এক গ্রেপ্তার, নির্যাতন ও বাধার মুখেও তিনি আন্দোলন চালিয়ে যান। এই আপসহীন আন্দোলনের ফলেই এরশাদের পতন ত্বরান্বিত হয়।
দীর্ঘ আন্দোলনের পর ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। জামায়াতে ইসলামীর সমর্থনে খালেদা জিয়া প্রথমবারের মতো দেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয়বার এবং ২০০১ সালে চারদলীয় জোটের নেতৃত্ব দিয়ে তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক)-এর চেয়ারপারসনের দায়িত্ব দু’বার পালন করেন। সংসদ নির্বাচনের ইতিহাসে তার একটি বিরল রেকর্ড রয়েছে—পাঁচটি সংসদ নির্বাচনে ২৩টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে প্রতিটি আসনেই তিনি বিজয়ী হয়েছেন।
২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত ওয়ান-ইলেভেনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ৩ সেপ্টেম্বর তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। দীর্ঘদিন কারাবাসের পর আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে তিনি জামিনে মুক্তি পান। এ সময় তাকে বিদেশে নির্বাসনে পাঠানোর চেষ্টা করা হলেও তিনি দেশ ছাড়তে অস্বীকৃতি জানান।
২০১০ সালের ১৩ নভেম্বর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় তাকে ক্যান্টনমেন্টের বাসা থেকে উচ্ছেদ করা হয়। খালেদা জিয়ার অভিযোগ ছিল, বলপ্রয়োগ করে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়, যেখানে তিনি প্রায় ২৮ বছর বসবাস করেছিলেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তার বিরুদ্ধে মোট ৩৭টি মামলা দায়ের হয়। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় তাকে সাজা দেওয়া হয়। বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকেই এসব মামলা করা হয়েছিল। সর্বশেষ ৬ আগস্ট সরকারের নির্বাহী আদেশে তার সাজা মওকুফ করা হয় এবং ২৭ নভেম্বর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় তিনি খালাস পান।
বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, কারাবন্দি অবস্থায় তাকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে ‘স্লো পয়জনিং’ করা হয়েছিল। উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর দাবি বারবার জানানো হলেও তৎকালীন সরকার তাতে সাড়া দেয়নি। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের আদেশে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়।
গৃহবধূ থেকে রাজনীতির শীর্ষ নেতৃত্বে উঠে আসা খালেদা জিয়ার জীবন ছিল সংগ্রাম, প্রতিকূলতা ও আপসহীনতার প্রতীক। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াই—প্রতিটি অধ্যায়ে তিনি ছিলেন দৃঢ় ও অনমনীয়। তার মৃত্যুতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক যুগের অবসান হলো বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



