ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘদিনের জটিলতা, করদাতা পরিচয়সংক্রান্ত অসঙ্গতি এবং আয়কর–ভ্যাট নিবন্ধনের দ্বৈত কাঠামো দূর করতে একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ নিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। প্রতিষ্ঠান–ব্যক্তি যাদের ব্যবসা পরিচালনার জন্য বর্তমানে আলাদা করে করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) এবং ব্যবসা শনাক্তকরণ নম্বর (বিআইএন) সংগ্রহ করতে হয়, সেই দুই নম্বরকে বাতিল করে একটি একক ইউনিক নম্বর চালুর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। উদ্দেশ্য—কর ব্যবস্থাকে সহজ করা, ব্যবসায় স্বচ্ছতা আনা, রাজস্ব আহরণ বাড়ানো এবং ভ্যাট–আয়কর–কাস্টমস—এই তিন বিভাগের মধ্যে ডিজিটাল সমন্বয় প্রতিষ্ঠা।
এই নতুন ইউনিক নম্বর ব্যবস্থাকে বাস্তবায়নের জন্য আয়কর, ভ্যাট, কাস্টমস ও আইটি উইংয়ের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের নিয়ে ১৯ সদস্যের উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি ইতোমধ্যে গঠন করা হয়েছে। কমিটি গত ১২ নভেম্বর থেকেই মাঠে নেমে জরিপ, ডেটা সমন্বয়, সফটওয়্যার বিশ্লেষণ এবং আইনগত প্রয়োজনীয়তা যাচাইয়ের কাজ শুরু করেছে। এনবিআরের শীর্ষ নেতৃত্বের দাবি, এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে দেশের পুরো কর ব্যবস্থায় এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হবে।
কেন ইউনিক নম্বর প্রয়োজন: খাতভেদে বড় ব্যবধানের বাস্তব চিত্র
বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৬ লাখ ৪৪ হাজার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভ্যাট নিবন্ধিত। তাঁদের মধ্যে মাসে গড়ে ৪ লাখ ৭৫ হাজারের মতো প্রতিষ্ঠান ভ্যাট রিটার্ন জমা দেয়, যার মধ্যে ৩ লাখ রিটার্ন অনলাইনে জমা পড়ে। অথচ দেশের নিবন্ধিত কোম্পানি করদাতাদের মধ্যে বার্ষিক আয়কর রিটার্ন জমা দেয় মাত্র ৩৯ হাজার ৬০০ প্রতিষ্ঠান—যা মোট নিবন্ধিত কোম্পানির (প্রায় ৩ লাখ) তুলনায় অস্বাভাবিকভাবে কম।
এই দুটি সংখ্যার ব্যবধানই প্রমাণ করে—আয়কর ও ভ্যাটের নিবন্ধন এবং কার্যক্রম এখনও সমন্বিত নয়। দুই দপ্তর আলাদা ডেটা ব্যবহার করায় একই প্রতিষ্ঠানের ভিন্ন ভিন্ন বিক্রি বা লেনদেন দেখিয়ে অনেক প্রতিষ্ঠান নির্বিঘ্নে কর ফাঁকি দিয়ে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, একজন কোম্পানি যখন এক দপ্তরে এক ধরনের বিক্রি দেখায় আর অপর দপ্তরে সম্পূর্ণ ভিন্ন তথ্য জমা দেয়, তখন প্রকৃত করনির্ধারণ কখনোই সম্ভব হয় না। ফলে রাজস্ব ফাঁকির সুযোগ তৈরি হয় এবং সরকারও উপযুক্ত পরিমাণ রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হয়।
ইউনিক নম্বর বাস্তবায়নে উচ্চপর্যায়ের কমিটির করণীয়
১৯ সদস্যের যে বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়েছে, তাদের মূল দায়িত্ব—
১. এক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের একাধিক টিআইএন ও বিআইএন শনাক্ত করা
এনবিআরের ডেটায় প্রায়শই দেখা যায়—একই ব্যক্তি বা কোম্পানির একাধিক টিআইএন, আবার ভিন্ন নামে আলাদা বিআইএন। এটি কর ফাঁকির অন্যতম পথ। নতুন ইউনিক নম্বর চালু হলে একজন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের জন্য থাকবে একটি নম্বর—এক্ষেত্রে নাম, এনআইডি, পাসপোর্ট, ব্যবসার ঠিকানা, ব্যাংক হিসাবসহ গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্য একই কোডে সংযুক্ত থাকবে।
২. বিদ্যমান সফটওয়্যার (আইভাস ও ইনকাম ট্যাক্স) ব্যবহার করা যাবে কি না—তা মূল্যায়ন
কমিটির আইটি বিশেষজ্ঞরা যাচাই করছেন—নতুন সফটওয়্যার তৈরি না করেও কি আইভাস (ভ্যাট সফটওয়্যার) ও ইনকাম ট্যাক্স অ্যাপ্লিকেশনকে একীভূত করে ইউনিক নম্বর চালু করা সম্ভব?
আইএমএফও পরামর্শ দিয়েছে—যেকোনো নতুন ব্যবস্থায় সফটওয়্যার ইন্টিগ্রেশনকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।
৩. আইনগত বাধা পরীক্ষা
আয়কর আইন, ভ্যাট আইন, কাস্টমস আইন—এই তিন আইনের সামঞ্জস্য নিশ্চিত করতে আইনি সংস্কারের দিকনির্দেশনাও দেবে কমিটি।
৪. রাজস্ব সম্ভাব্যতা বিশ্লেষণ
একক নম্বর চালুর ফলে কতটুকু রাজস্ব বৃদ্ধি হতে পারে, কোন কোন খাতে ফাঁকি রোধ হবে—সে বিষয়ে উচ্চপর্যায়ের বিশ্লেষণ।
রাজস্ব গবেষকদের মতামত: “এ উদ্যোগ কার্যকর করতে হবে শতভাগ অটোমেশন”
র্যাপিডের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আবু ইউসুফ বলেছেন— “এ উদ্যোগ প্রশংসনীয়, কিন্তু এনবিআরের পূর্ণাঙ্গ অটোমেশন ছাড়া এটি বাস্তবে সফল হবে না। ম্যানুয়াল ব্যবস্থায় রাজস্ব ফাঁকি রোধ করা অসম্ভব।”
তিনি উদাহরণ দেন—
-
এনবিআর প্রায় ৫–৬ লাখ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করেছে ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) বসানোর জন্য,
-
কিন্তু স্থাপন করেছে মাত্র ১১ হাজারটিতে।
তাঁর মতে, ইলেকট্রনিক সিস্টেম পুরোপুরি চালু করতে পারলে ভ্যাট আদায় তিনগুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে।
এ ছাড়া সিটি করপোরেশন, ওয়াসা, ডেসকোসহ সরকারি সংস্থার মধ্যে তথ্য আদান-প্রদান শক্তিশালী করা গেলে আয়করের রাজস্বও উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে।
সমন্বয়হীনতার কারণে কী ধরনের ফাঁকি হচ্ছে?
এনবিআরের দুই বিভাগের কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন— আয়কর ও ভ্যাট একে অপরের ডেটা শেয়ার না করায় বড় ফাঁকির সুযোগ সৃষ্টি হয়।
উদাহরণস্বরূপ—
-
অনেক প্রতিষ্ঠান ভ্যাট বিভাগে কম বিক্রি দেখিয়ে রিটার্ন জমা দেয়,
-
অথচ তাদের অডিট রিপোর্টে দেখানো বিক্রির পরিমাণ আরও বেশি।
-
কর বিভাগের কাছে জমা দেওয়া ব্যালান্স শিটে লাভ বেশি দেখানো হলেও ভ্যাট দপ্তরের কাছে জমা দেওয়া নথিতে বিক্রি কম দেখানো হয়।
এই দুই তথ্যের মিল না হওয়ায় কর ফাঁকির প্রকৃত পরিমাণ সনাক্ত করা যায় না। ফলে কর নির্ধারণও ভুল হয়।
ইউনিক নম্বর চালু হলে— এক ক্লিকেই একটি প্রতিষ্ঠানের আয়কর, ভ্যাট, আমদানি–রপ্তানি সব তথ্য দৃশ্যমান হবে।
এতে কর ফাঁকির সুযোগ প্রায় শূন্যে নেমে আসবে বলে মনে করেন কর্মকর্তারা।
এনবিআর চেয়ারম্যান: “একক নম্বর রাজস্ব বহু গুণ বাড়াবে”
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান বলেন— “মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি রাজস্ব কৌশলের অংশ হিসেবে ইউনিক নম্বর চালুর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এটি বাস্তবায়ন করতে পারলে রাজস্ব আদায় বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে।”
তিনি আরও জানান— আয়কর ও ভ্যাটের জন্য পৃথক বড় করদাতা ইউনিট রাখার যৌক্তিকতাও ভবিষ্যতে কমে যাবে। একটি বড় ইউনিটে হিসাববিদ, ট্যাক্স বিশেষজ্ঞ, অডিটর—সবাই একসঙ্গে কাজ করবে। এতে বড় করদাতাদের সময় ও খরচ উভয়ই কমবে।
কর বিশেষজ্ঞদের আরও মতামত
সিপিডির ড. মোস্তাফিজুর রহমানের মতামত
-
ইউনিক নম্বর চালুর মাধ্যমে একজন ব্যক্তির জীবনযাত্রা ও ব্যয়ের ধরন সহজেই শনাক্ত করা সম্ভব হবে।
-
কেউ বছরে তিনবার বিদেশ ভ্রমণ করেন, দামি গাড়ি ব্যবহার করেন, কিন্তু আয়কর দেন মাত্র ১ লাখ টাকা—এ ধরনের অসামঞ্জস্য সহজেই ধরা পড়বে।
-
ভারতে যেমন আধার ও প্যান কার্ডের মাধ্যমে সব লেনদেন ট্র্যাক করা হয়, বাংলাদেশেও তেমন ব্যবস্থা চালুর প্রয়োজন রয়েছে।
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ড. মাশরুর রিয়াজ
-
বিশ্বের যেসব দেশে উন্নত রাজস্ব কাঠামো আছে, সেসব দেশে পরোক্ষ কর ও প্রত্যক্ষ কর বিভাগের মধ্যে শক্তিশালী ইন্টিগ্রেশন রয়েছে।
-
বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে এই দুটি বিভাগের মধ্যে তথ্য আদান–প্রদান নেই বললেই চলে।
-
টিআইএন ও বিআইএনকে একীভূত করে ইউনিক নম্বর চালু করলে এই বড় সমস্যার সমাধান হবে।
ইউনিক নম্বর চালুর প্রভাব: কী কী পরিবর্তন আসবে
১. করদাতার পরিচয় হবে একক এবং ডিজিটাল
একজন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সব আর্থিক কার্যক্রম একই নম্বরে শনাক্ত করা যাবে।
২. রাজস্ব ফাঁকি রোধে রিয়েল টাইম ডেটা
ভ্যাট–আয়কর–কাস্টমস—সব বিভাগ একই উৎস থেকে তথ্য নেবে।
৩. অডিট দ্রুত ও নির্ভুল হবে
একটি প্রতিষ্ঠানের সব হিসাব একসঙ্গে দেখা যাবে, ফলে অডিট কার্যক্রম হবে স্বচ্ছ।
৪. ব্যবসায়ীদের ঝামেলা কমবে
দুটি আলাদা নম্বর না নিয়ে একটি নম্বরে সব কাজের সুযোগ।
৫. সরকারের রাজস্ব আয় উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে
বিশেষজ্ঞরা বলছেন—সফটওয়্যার ও তথ্যসমন্বয় ঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে রাজস্ব আয় ৩০–৫০% পর্যন্ত বাড়তে পারে।
এনবিআরের ইউনিক নম্বর চালুর উদ্যোগ কেবল একটি প্রযুক্তিগত পরিবর্তন নয়, বরং পুরো কর ব্যবস্থার কাঠামোগত সংস্কারের সূচনা। তথ্য একীভূত হলে কর ফাঁকি কমবে, করদাতার পরিচয় পরিষ্কার হবে, ব্যবসা পরিচালনায় স্বচ্ছতা বাড়বে এবং সরকারের রাজস্ব আহরণ হবে বহুগুণ।
একই সঙ্গে এনবিআরকে ডিজিটাল অটোমেশন, আন্তঃসংস্থাগত ডেটা শেয়ারিং এবং সফটওয়্যার ইন্টিগ্রেশনের মতো ক্ষেত্রগুলোকে অগ্রাধিকার দিতে হবে—তাহলেই নতুন ইউনিক নম্বর ব্যবস্থা বাস্তবে সফল হবে।
বাংলাবার্তা/এসজে
.png)
.png)
.png)



