ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) দুই ভাগে বিভক্তির সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে গত মে-জুন মাসে যে টানাপোড়েন, কলম বিরতি, কমপ্লিট শাটডাউন ও নানা ধরনের আন্দোলন হয়েছিল, সেই ঘটনাগুলোর পুঙ্খানুপুঙ্খ মূল্যায়ন করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শাস্তি, বহিষ্কার ও চাকরিচ্যুতির বিষয়ে সরকার ইতিবাচক সমাধান খুঁজবে বলে জানালেন সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। আন্দোলনকালীন উত্তেজনা, ভুল বোঝাবুঝি এবং প্রশাসনিক সংকটের পটভূমিতে তিনি পরিষ্কারভাবে জানান, রাষ্ট্রের প্রয়োজনে শৃঙ্খলা বজায় রাখা যেমন জরুরি, তেমনি কর্মীদের মনোবল, মর্যাদা ও কর্মপরিবেশ সুস্থ না থাকলে কর প্রশাসনে কাঙ্ক্ষিত উন্নতি সম্ভব নয়।
শনিবার (১৫ নভেম্বর) রাজধানীর আগারগাঁওয়ের চীন-মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (ট্যাক্সেশন) অ্যাসোসিয়েশনের অন্তরঙ্গন ক্রীড়া প্রতিযোগিতা–২০২৫ এর পুরস্কার বিতরণ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপলক্ষে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান, সদস্য জি. এম. আবুল কালাম কায়কোবাদসহ এনবিআরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। সভাপতিত্ব করেন অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও এনবিআরের সদস্য মোতাসিম বিল্লাহ ফারুকী। স্বাগত বক্তব্যে মহাসচিব সৈয়দ মহিদুল হাসান এনবিআরের সাম্প্রতিক সংকট ও সম্ভাবনার বিষয় তুলে ধরেন।
ড. সালেহউদ্দিন বলেন, এনবিআরকে আয়কর এবং শুল্ক-ভ্যাট বিভাগে দুই ভাগ করার সরকারি সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে হঠাৎ করেই যে অসন্তোষ সৃষ্টি হলো, তা প্রায় দুই মাস ধরে চলেছে। কলম বিরতি, বিভিন্ন পর্যায়ের শাটডাউন কর্মসূচি কর প্রশাসনের কার্যক্রমকে স্থবির করে দেয়। এতে সরকারের রাজস্ব আদায়ের গুরুত্বপূর্ণ সময়—বাজেট-পরবর্তী মাসগুলো—চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
তিনি জানান, সরকার তখন অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছে। আন্দোলনের সময় বিভিন্ন পর্যায়ে অভিযোগ উত্থাপিত হলেও সেসব নিয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়নি। কারণ—
“এদের চাকরির ওপরই তাদের পরিবার-পরিজনের রুটি-রুজি নির্ভর করে। তাই আমরা তখন নেতিবাচক মনোভাব নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত দিইনি।”
তবে আন্দোলনের সময় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী সাময়িক বরখাস্ত এবং কয়েকজন চাকরিচ্যুত হন। এই বিষয়ে তিনি বলেন— “যা হয়ে গেছে, সেটি নিয়ে আমরা ইতিবাচক চিন্তা করব। কর্মপরিবেশ ভালো রাখতে এবং কর্মীদের মাঝে আস্থার সংকট দূর করতে সরকার যথাসম্ভব সমাধানের পথ খুঁজবে।”
ড. সালেহউদ্দিন স্বীকার করেন, এনবিআর বিভক্তির সিদ্ধান্ত ও পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে তাকে ব্যক্তিগতভাবে টার্গেট করে কটূক্তি, সমালোচনা ও আক্রমণ করা হয়েছে।
তার ভাষায়— “আমার কোনো ফেসবুক অ্যাকাউন্ট নেই। তবে বিদেশে থাকা আত্মীয়-স্বজন আমাকে জানিয়েছেন, কিছু এনবিআর কর্মকর্তা আমাকে নিয়ে এমন কিছু পোস্ট করেন যা আমি দেখলে মেনে নিতে পারতাম না, অনেক সময় মাথা নষ্ট হয়ে যেতে পারত।”
তিনি বলেন, তিনি এসব ব্যক্তিগত আক্রমণকে গুরুত্ব দেন না। কিন্তু রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ নীতি বাস্তবায়নে যাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, তাদের থেকে দায়িত্বশীল আচরণ প্রত্যাশা করা হয়। সমালোচনা থাকতেই পারে, কিন্তু তা যেন যুক্তির মধ্যে থাকে।
অর্থ উপদেষ্টা কর প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উদ্দেশে বলেন— “করদাতারা রাষ্ট্রের রাজস্ব জোগায়। তাই তাদের সঙ্গে নম্র, ভদ্র আচরণ করতে হবে। কোনো অবস্থাতেই বৈষম্য বা অন্যায় কর আদায় গ্রহণযোগ্য নয়।”
তিনি আরও বলেন, ভ্যাট ও কর সংগ্রহের ক্ষেত্রে দক্ষতা বাড়াতে হবে। তবে দক্ষতার চেয়েও বেশি প্রয়োজন সততা ও স্বচ্ছতা। “ব্যবসায়ীরা সবসময়ই কম কর দিতে চাইবে বা ফাঁকির পথ খুঁজবে। এটা আপনাদেরই সততা, প্রজ্ঞা ও পেশাদারিত্ব দিয়ে মোকাবিলা করতে হবে।”
অনুষ্ঠানে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান বলেন, সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আয়কর ও শুল্ক-ভ্যাট বিভাগ আলাদা কাঠামোয় পরিচালিত হবে। এর লক্ষ্য কর প্রশাসনের দক্ষতা বৃদ্ধি, ট্যাক্স–জিডিপি অনুপাত উন্নয়ন এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা।
তিনি বলেন— “এটি কাঠামোগত পরিবর্তন। তাই প্রথমদিকে কিছু অসন্তোষ থাকতেই পারে। তবে নতুন কাঠামো কর প্রশাসনকে দীর্ঘমেয়াদে শক্তিশালী করবে।”
অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোতাসিম বিল্লাহ ফারুকী বলেন, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যেন শাস্তি নিয়ে আতঙ্কে না থাকেন। যাতে যোগ্যতার মূল্যায়ন হয় এবং যুক্তি–সংগত সমাধান পাওয়া যায়—এই প্রত্যাশা রাখছেন তারা।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ মনে করিয়ে দেন, দেশের অর্থনীতি এখন জটিল চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে—রাজস্ব ঘাটতি, আন্তর্জাতিক ঋণ কাঠামো, মুদ্রাস্ফীতি, আমদানি নিয়ন্ত্রণসহ নানা বিষয় তার সঙ্গে জড়িত। এসময় কর প্রশাসনের একতা, কার্যকারিতা ও স্বচ্ছতা অত্যন্ত জরুরি। তিনি বলেন— “এনবিআরের পরিবেশ উন্নত হলে কর্মীদের কাজের আগ্রহ বাড়বে। আর কর্মস্পৃহা বাড়লে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা আরও শক্তিশালী হবে, যা দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
এনবিআর বিভক্তিকরণকে ঘিরে উত্তেজনা, আন্দোলন, বিভ্রান্তি ও শাস্তিমূলক সিদ্ধান্তে দীর্ঘদিন ধরে যে অস্থিরতা চলছিল, অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের বক্তব্যে তার সমাধানের একটি ইতিবাচক নির্দেশনা পাওয়া গেছে। তিনি পরিষ্কারভাবে জানিয়েছেন—অতীতের ভুল বোঝাবুঝি ভুলে সামনের দিনে কর প্রশাসনকে আরও দক্ষ, মানবিক ও স্বচ্ছ করতে সরকার ও এনবিআর একসঙ্গে কাজ করবে।
এই ঘোষণায় অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে নতুন করে স্বস্তি, আশা এবং আস্থার পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
বাংলাবার্তা/এসজে
.png)
.png)
.png)



