ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায় মৃত্যুদণ্ডকে সবচেয়ে কঠোর ও চরম শাস্তি হিসেবে ধরা হয়। খুন, ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যা, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, রাষ্ট্রদ্রোহ, সন্ত্রাসবিরোধী আইনসহ বহু ক্ষেত্রে আদালত মৃত্যুদণ্ড দিয়ে থাকে। কিন্তু দেশের ৫৪ বছরের স্বাধীন ইতিহাসে আজ পর্যন্ত কোনো নারী আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার ঘটনা ঘটেনি। যদিও বর্তমানে দেশের বিভিন্ন কারাগারে মোট ৯৪ জন নারী মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি রয়েছেন। এদের মধ্যে অনেকেই বহু বছর ধরে আইনি প্রক্রিয়া ও আপিলের অপেক্ষায় কারাজীবন কাটাচ্ছেন। কারাগারের সর্বশেষ হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামির সংখ্যা ২ হাজার ৫৯৪ জন, যেখানে বিপুল সংখ্যাই পুরুষ।
সোমবার রাত পর্যন্ত পাওয়া কারা অধিদপ্তরের সরকারি হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের সব কারাগারে মোট বন্দির সংখ্যা ৮২ হাজারের বেশি। অথচ এই সব কারাগারের সম্মিলিত ধারণক্ষমতা মাত্র ৪২ হাজার ৮৭৭ জন। ফলে ধারণক্ষমতার প্রায় দ্বিগুণ বন্দিকে সামলাতে হচ্ছে কারা কর্তৃপক্ষকে। দেশের ১৪টি কেন্দ্রীয় কারাগার এবং ৬০টি জেলা কারাগারের ওপর এই অতিরিক্ত চাপ সরাসরি প্রভাব ফেলছে বন্দিদের জীবনযাপন, নিরাপত্তা, এবং পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার ওপর।
এই বিপুল জনসমুদ্রের ভিড়ের মধ্যেই রয়েছে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামিদের আলাদা একটি জগত—মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির সেল বা ‘ডেথ রো’। সমাজের সাধারণ মানুষের কাছে ডেথ রো যেন এক রহস্যময়, ভীতিকর এলাকা। তবে কারা কর্মকর্তারা বলছেন, অনেক প্রচলিত ধারণাই বাস্তবে সত্য নয়।
সাবেক ডিআইজি (প্রিজন্স) মেজর (অব.) শামসুল হায়দার সিদ্দিকী বলেন, দেশে নারীর ফাঁসি কার্যকর না হওয়ার কারণ আইন নয়—বরং আইনি প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা। তিনি স্পষ্ট করে জানান:
বাংলাদেশের আইনে নারী বা পুরুষ—কেউই ফাঁসি থেকে অব্যাহতি পায় না।
কিন্তু ফাঁসির দণ্ড কার্যকর করতে হলে কয়েকটি বাধ্যতামূলক ধাপ অতিক্রম করতে হয়—আপিল বিভাগ, রিভিউ, রাষ্ট্রপতির কাছে mercy petition (ক্ষমার আবেদন) ইত্যাদি।
এখন পর্যন্ত কোনো নারী আসামির ক্ষেত্রে এই সব ধাপ পুরোপুরি শেষ হয়নি। ফলে আইনগতভাবে মৃত্যুদণ্ড থাকলেও তা কার্যকর করা সম্ভব হয়নি।
তিনি আরও বলেন, অনেক সময় নারীর অপরাধে সহানুভূতির জায়গা তৈরি হয়, পরিবার-সমাজ বিচারপ্রক্রিয়ায় নানা জটিলতা তৈরি করে, এবং আইনি লড়াই দীর্ঘায়িত হওয়ায় তারা বছরের পর বছর কারাগারেই থেকে যান।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত নারী বন্দিদের জীবনযাপন: কীভাবে কাটে দিনগুলো?
কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন বলেন, একটি সাধারণ ভুল ধারণা হলো—যে কেউ ফাঁসির দণ্ডাদেশ পেলে তাকে কনডেম সেলে আটকে রাখা হয়। বাস্তবে বাংলাদেশ কারাগারে নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই পৃথকভাবে ‘মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বন্দিদের সেল’ নামে একটি ব্যবস্থা অনুসরণ করা হয়।
কোনো সেলে একজন একা থাকেন, আবার কখনও দুই–তিনজন একসঙ্গে থাকেন।
এখন আর আগের মতো কঠোর সীমাবদ্ধতা নেই; সাক্ষাৎ, চিকিৎসা ও দৈনন্দিন কার্যক্রম কিছুটা শিথিল করা হয়েছে।
তিনি বলেন, দেশে আজ পর্যন্ত কোনো নারীর ফাঁসি কার্যকর না হলেও তারা মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বন্দি হিসেবেই কারাগারে থাকেন এবং নিয়মিত কারা কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে জীবনযাপন করেন।
বাংলাদেশে কারাগার ও ফাঁসি নিয়ে অনেক প্রচলিত মিথ আছে। এগুলো সম্পর্কে সাবেক ডিআইজি শামসুল হায়দার সিদ্দিকী বলেন:
একসময় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত বন্দিদের সেল থেকে বের হতে দেওয়া হতো না। এখন নিয়ম বদলেছে।
আগে সর্বোচ্চ পাঁচজন আত্মীয় স্বজন সেলে গিয়ে দেখা করতে পারতেন; এখন সাক্ষাৎ আগের তুলনায় অনেক সহজ।
অনেক মানুষ বিশ্বাস করেন রমজান মাসে কেউ ফাঁসি হয় না—যদিও বাস্তবে আইনে এমন নিষেধাজ্ঞা নেই।
তবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের সামাজিক বাস্তবতার কারণে রমজানে ফাঁসি কার্যকর না করাই প্রচলিত প্রথা।
কারাগারের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, বর্তমানে দেশের সব কারাগারে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত নারী বন্দি ৯৪ জন, যার মধ্যে একমাত্র গাজীপুরের কাশিমপুর মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারেই আছেন ৫৪ জন নারী। এই কারাগারকে বলা হয় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত নারী আসামিদের প্রধান কেন্দ্র।
নারীরা কী ধরনের অপরাধে জড়াচ্ছেন?
কারা কর্মকর্তাদের মতে, আগে নারীর অপরাধের ধরন সীমিত ছিল। কিন্তু গত এক দশকে নারী জড়িত অপরাধের ধরন ও মাত্রা দুই–ই পরিবর্তিত হয়েছে। নারী মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের বিরুদ্ধে প্রধান যে অভিযোগগুলো পাওয়া যায়:
স্বামী খুন
পারিবারিক বিরোধে হত্যাকাণ্ড
শিশুহত্যা
যৌথ পরিকল্পনায় হত্যার সহায়তা
মাদকদ্রব্য সম্পর্কিত বড় অপরাধ
সম্পত্তি নিয়ে সংঘাত
তবে এই মামলাগুলোর অনেকগুলোতেই দেখা যায় সামাজিক ও পারিবারিক জটিলতা, দাম্পত্য নির্যাতন, অথবা দীর্ঘমেয়াদী মানসিক নির্যাতনের ইতিহাস।
আইনি প্রক্রিয়ার জটিলতা: কেন এত সময় লাগে?
মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আগে যে ধাপগুলো অতিক্রম করতে হয়:
হাইকোর্ট বিভাগে আপিল
আপিল বিভাগে আবেদন
রিভিউ আবেদন
রাষ্ট্রপতির কাছে mercy petition
চূড়ান্ত কার্যকর-নির্দেশ
নারী আসামিদের ক্ষেত্রে দেখা যায়:
পরিবার সাধারণত দীর্ঘসময় আইনি লড়াই চালিয়ে যায়
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর নজর থাকে
সমাজের কাঠামো নারীর প্রতি কিছুটা সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠে
অনেক সময় নথি, সাক্ষ্য, তদন্ত—এসব নিয়ে সমস্যা তৈরি হয়
ফলে আইনগতভাবে মৃত্যুদণ্ড থাকা সত্ত্বেও নারী আসামিদের ফাঁসি বাস্তবে কার্যকর হয় না।
বিশেষজ্ঞদের মতামত: ভবিষ্যতেও কি নারীর ফাঁসি হবে?
আইন বিশ্লেষকরা বলছেন:
আইন অনুসারে নারীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার বাধা নেই
তবে সামাজিক, মানবাধিকার, আন্তর্জাতিক চাপ, বিচারবিভাগীয় ‘সাধু বিবেচনা’—সব মিলিয়ে নারীর ফাঁসি বাংলাদেশে খুব কম সম্ভাবনাময়
ভবিষ্যতেও এই প্রবণতা অব্যাহত থাকতে পারে
একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারক বলেন— “নারীর প্রতি রাষ্ট্রীয় সহানুভূতি নীরবে কাজ করে। আইনের চোখে নারী-পুরুষ সমান হলেও কর্মক্ষেত্রে নারীকে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে রাষ্ট্র নানা বাস্তবতা বিবেচনা করে।”
বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা, কারাগারব্যবস্থা, এবং সমাজ—তিনটির মধ্যকার সমন্বয়ে নারীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর না হওয়ার একটি দীর্ঘ ঐতিহ্য তৈরি হয়েছে। যদিও আইনে লিঙ্গভেদ নেই, তবুও বাস্তবে নারীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর না হওয়ার ঘটনাটি দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি, সামাজিক মনস্তত্ত্ব এবং বিচারিক প্রক্রিয়ার একটি অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বর্তমানে ৯৪ নারী মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বন্দি তাদের জীবনের অনিশ্চিত পরিণতি নিয়ে কারাগারে দিন কাটাচ্ছেন। তারা কেউ হয়তো মুক্তি পাবেন, কেউ কম সাজা পাবেন, কেউ হয়তো আজীবন কারাবাসে থাকবেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত যা দেখা গেছে—বাংলাদেশে কোনো নারীর ফাঁসির দড়ি পর্যন্ত যাত্রা কখনোই সম্পন্ন হয়নি।
আপনি চাইলে আমি এটি আরও বড়, আরও বিশ্লেষণধর্মী বা ব্যাকগ্রাউন্ডসহ আরও সমৃদ্ধ সংস্করণ লিখে দিতে পারি।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



