ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) বর্তমান সভাপতি ফারুক আহমেদ আনুষ্ঠানিকভাবে তার পদ হারিয়েছেন। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে তার পরিচালক পদ বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে, যার ফলে স্বাভাবিক নিয়মে তিনি আর বোর্ডের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনের যোগ্যতা রাখেন না। এই প্রজ্ঞাপন বিসিবিতে এক ধরনের ভূমিকম্প তৈরি করেছে। ফলে বিসিবির শীর্ষ চেয়ারে নতুন নেতৃত্ব আসার পথ খুলে গেলো।
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের জারি করা প্রজ্ঞাপন অনুসারে, ফারুক আহমেদের পরিচালক পদ বাতিল করা হয়েছে প্রশাসনিক ও নীতিগত কারণে। অর্থাৎ তিনি যেহেতু ক্রীড়া পরিষদের কোটা থেকে বিসিবির পরিচালক হিসেবে এসেছিলেন, সেই নিয়োগ বাতিল হওয়ার অর্থ হলো তিনি বিসিবির পরিচালনা পর্ষদে আর বৈধ নন। বোর্ডের সংবিধান অনুযায়ী, পরিচালনা পর্ষদের বাইরে থেকে কেউ বিসিবির সভাপতি হতে পারেন না।
ফলে এই প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতির পদ এখন আনুষ্ঠানিকভাবে শূন্য হয়ে গেছে। নতুন সভাপতি কে হবেন—সে প্রশ্ন এখন ক্রিকেট অঙ্গনের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়।
বিসিবির অভ্যন্তরে চলমান টানাপোড়েন এবং নেতৃত্বের দ্বন্দ্বই ফারুক আহমেদের অপসারণে বড় ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করছেন ক্রীড়া সংশ্লিষ্টরা। বিশেষ করে, সম্প্রতি বিসিবির ৮ জন পরিচালক তার বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণে একক মনোভাব এবং বোর্ডের স্বার্থ বিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগ এনে যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বরাবর একটি চিঠি দেন। ওই চিঠিতে স্বাক্ষর করেন—নাজমুল আবেদিন ফাহিম, মাহবুব আনাম, ফাহিম সিনহা, সাইফুল ইসলাম স্বপন চৌধুরি, ইফতেখার রহমান মিঠু, কাজী ইনাম আহমেদ, মঞ্জুর আলম এবং মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন চৌধুরী।
চিঠিতে অভিযোগ করা হয়, ফারুক আহমেদ বোর্ডের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো এককভাবে নিচ্ছিলেন এবং বোর্ডের প্রতিষ্ঠিত নিয়ম ও রীতি উপেক্ষা করছিলেন। তার এমন আচরণে অসন্তোষ তৈরি হয় পরিচালকদের মাঝে, যা শেষ পর্যন্ত অনাস্থায় রূপ নেয়।
জানা গেছে, ফারুক আহমেদকে বিসিবির পরিচালকের পদে মনোনয়ন দিয়েছিল জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ—যার নিয়ন্ত্রণ ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের হাতেই। ২০২৩ সালের আগস্টে দেশব্যাপী ছাত্র আন্দোলনের ফলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও নির্বাসনের পর পুরো রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় ব্যাপক রদবদল ঘটে। প্রশাসন, বিচার বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মতো ক্রীড়াঙ্গনেও সেই পরিবর্তনের ঢেউ এসে লাগে।
সেই সময়েই নতুন প্রশাসনের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত ফারুক আহমেদকে বিসিবির পরিচালক হিসেবে ক্রীড়া পরিষদের পক্ষ থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। পরে পরিচালকদের ভোটে তিনি বোর্ডের সভাপতির দায়িত্ব পান। তবে বোর্ডের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং তার সিদ্ধান্ত গ্রহণের পদ্ধতি নিয়ে অভিযোগের ভিত্তিতে শেষ পর্যন্ত তাকে সরিয়ে দেওয়ার পথেই হেঁটেছে ক্রীড়া পরিষদ।
ফারুক আহমেদের অপসারণের পর নতুন বিসিবি সভাপতি নিয়োগে সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকায় উঠে এসেছে কয়েকটি নাম। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত নাম জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ও আইসিসি'র প্রাক্তন উন্নয়ন কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম বুলবুল। ক্রিকেট পাড়ায় পরিচিত ‘বুলবুল’ নামে পরিচিত এই সাবেক ব্যাটসম্যান নিজেও এক সময় বিসিবির অভ্যন্তরীণ রাজনীতির শিকার হয়ে প্রান্তিক হয়ে পড়েছিলেন।
তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট প্রশাসনে কাজ করার অভিজ্ঞতা এবং দলের প্রতি তার নিষ্ঠা ও পেশাদারিত্ব তাকে একটি গ্রহণযোগ্য প্রার্থী হিসেবে সামনে নিয়ে এসেছে। অনেকেই মনে করছেন, দেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামো আমিনুল ইসলাম বুলবুলকে নেতৃত্বে আনতে আগ্রহী।
ক্রিকেট বিশ্লেষক ও সাবেক ক্রীড়া সাংবাদিক রফিকুল ইসলাম বলেন, “ফারুক আহমেদ একজন সৎ ব্যক্তি হলেও বিসিবির অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কৌশল তার আয়ত্তে ছিল না। বোর্ড পরিচালনায় যে ধৈর্য, সমঝোতা ও কৌশল প্রয়োজন—তা তার মধ্যে ছিল না বলেই অনাস্থার শিকার হয়েছেন।”
অপর এক ক্রীড়া গবেষক ড. কামরুজ্জামান মত দেন, “রাজনৈতিক পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে ক্রীড়াঙ্গনের নেতৃত্বেও বড় পরিবর্তন আসে। বিসিবি বর্তমানে খুব স্পর্শকাতর অবস্থায় রয়েছে। তাই এমন সময়ে যোগ্য, পেশাদার এবং রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ কাউকে সভাপতি হিসেবে আনাই হবে সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত সিদ্ধান্ত।”
ফারুক আহমেদের বিদায়ে বিসিবি কার্যনির্বাহী কমিটিতে কিছুটা অস্থিরতা তৈরি হলেও অনেকেই এটিকে ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা হিসেবে দেখছেন। ক্রিকেট বোর্ডের পরবর্তী সভাপতি কে হচ্ছেন তা নির্ভর করছে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সিদ্ধান্ত ও বোর্ড পরিচালকদের অভ্যন্তরীণ সমঝোতার ওপর।
বর্তমানে বিশ্বকাপ, ঘরোয়া লিগ সংস্কার ও জাতীয় দলের অব্যাহত ব্যর্থতা মোকাবিলায় বিসিবির সামনে গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এমন সময়ে নতুন নেতৃত্ব এই বোর্ডকে কতটা পেশাদার ও দৃষ্টিনন্দনভাবে পরিচালনা করতে পারে—তা দেশের ক্রিকেটের ভবিষ্যতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



