ছবি: সংগৃহীত
দীর্ঘ টানাপোড়েন, নীরব দরকষাকষি ও দফায় দফায় বৈঠকের পর অবশেষে জাতীয় নির্বাচনের আসন সমঝোতার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বাধীন যুগপৎ আন্দোলনের শরিক রাজনৈতিক দলগুলো। শনিবার দিনভর এবং গভীর রাত পর্যন্ত একাধিক বৈঠক হয়েছে। আলোচনা চলবে রোববারও। সবকিছু ঠিক থাকলে রোববারই আসন সমঝোতা নিয়ে ঐকমত্যের ঘোষণা আসতে পারে বলে একাধিক শীর্ষ রাজনৈতিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
যুগপৎ আন্দোলনের শরিক রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা বলছেন, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই তারা আসন সমঝোতার চূড়ান্ত দোরগোড়ায় পৌঁছাতে চান। শুধু বিদ্যমান শরিক দলগুলোর মধ্যেই নয়, এই সমঝোতার আওতায় নতুন করে আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দলকে যুক্ত করার জোর আলোচনা ও প্রচেষ্টা চলছে। ইতোমধ্যে অন্তত দুটি দলের সঙ্গে নীতিগত ঐকমত্য হয়েছে বলে জানা গেলেও, আসন বণ্টনের চূড়ান্ত সমীকরণ এখনো প্রকাশ করা হয়নি।
নতুন চার দল নিয়ে জোর আলোচনা
সর্বশেষ আলোচনায় যে চারটি রাজনৈতিক দলের নাম সামনে এসেছে, সেগুলো হলো— কর্নেল (অব.) অলি আহমদের নেতৃত্বাধীন লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (এলডিপি), আ স ম আবদুর রবের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এবং ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরানের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ লেবার পার্টি।
বিশেষ করে গত দুই দিনে আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, সমঝোতার ভিত্তিতে আসন বণ্টনের এই জোটে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ অন্তত আটটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হতে যাচ্ছে এনসিপি। একাধিক শীর্ষ রাজনৈতিক নেতা নিশ্চিত করেছেন, চূড়ান্ত ঘোষণা এলে সেখানে এনসিপির নাম থাকছে।
রাতভর বৈঠক, সময়ের চাপ
যুগপৎ আন্দোলনের শরিক রাজনৈতিক দলগুলোর অন্যতম সমন্বয়কের দায়িত্বে থাকা জামায়াতে ইসলামীর এক শীর্ষ নেতা জানান, টানা কয়েকদিন ধরে আসন ধরে ধরে আলোচনা চলছে। একেকদিন একেকটি বিষয় সামনে আসছে। এনসিপিসহ নতুন কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও সমান্তরালে আলোচনা হয়েছে। শনিবার দিনভর বৈঠকের পর রাতেও আলোচনা চলেছে। সময় খুবই কম। তাই রোববারের মধ্যেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর বিষয়ে সবাই আশাবাদী।
জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নতুন রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে পৃথক ও যৌথ—দুই ধরনের বৈঠক হয়েছে। এসব বৈঠকে অংশ নিয়েছেন যুগপৎ আন্দোলনে আগে থেকেই সক্রিয় আট দলের শীর্ষ নেতারা।
নীতিগত কাঠামো ও ঘোষণার প্রস্তুতি
বৈঠকগুলোতে আসন সমঝোতার নীতিগত কাঠামো, প্রার্থী দেওয়ার কৌশল, সমন্বয় প্রক্রিয়া এবং ঘোষণার সময়সূচি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সমঝোতা চূড়ান্ত হলে যৌথভাবে অথবা পৃথক বিবৃতির মাধ্যমে তা জানানো হতে পারে। আগামী ৩ জানুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর ঘোষিত মহাসমাবেশে আসন সমঝোতার চূড়ান্ত শরিক দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের উপস্থিত থাকার সম্ভাবনাও রয়েছে।
কীভাবে শুরু হয়েছিল সমঝোতার আলোচনা
গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে জামায়াতে ইসলামী ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি ও জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা)–কে নিয়ে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে আসন সমঝোতার ভিত্তিতে সব আসনে একক প্রার্থী দেওয়ার আলোচনা শুরু করে। পরে এতে যোগ দেয় বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি। জামায়াতসহ এই আটটি দল বিভিন্ন দাবিতে দীর্ঘদিন অভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে মাঠে সক্রিয় ছিল।
এই আলোচনার মূল উদ্দেশ্য ছিল, নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে বিভক্ত না হয়ে একক ও শক্ত অবস্থান তৈরি করা। তবে আলোচনা শুরুর কিছুদিনের মধ্যেই জট তৈরি হয়। কে কোন আসনে প্রার্থী দেবে, কোন দল কতটি আসন পাবে—এ নিয়ে মতপার্থক্য প্রকাশ্য হয়ে ওঠে।
জট, স্থবিরতা ও নতুন কৌশল
আলোচনায় অংশ নেওয়া প্রতিটি দলই নিজেদের সাংগঠনিক শক্তি, অতীতের নির্বাচনী অভিজ্ঞতা এবং মাঠপর্যায়ের সমর্থনের যুক্তি তুলে ধরে বেশি আসনের দাবি তোলে। কেউ ছাড় দিতে রাজি না হওয়ায় একপর্যায়ে সমঝোতা প্রক্রিয়া স্থবির হয়ে পড়ে। এমনকি জোট ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কাও তৈরি হয়, যদিও প্রকাশ্যে কেউ তা স্বীকার করেননি।
এই পরিস্থিতিতে জামায়াতে ইসলামী কৌশল বদলায়। একসঙ্গে সবাইকে বসানোর বদলে ধাপে ধাপে পৃথক আলোচনার পথ বেছে নেওয়া হয়। এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ কয়েকটি দলের সঙ্গে আলাদাভাবে বৈঠক করে একটি বাস্তবসম্মত সমঝোতার পথ খোঁজা হয়। এতে আলোচনায় গতি আসে এবং ধীরে ধীরে সমঝোতার ভিত্তি তৈরি হয়।
৩০০ আসন বণ্টনের নীতিগত সিদ্ধান্ত
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, সর্বশেষ আলোচনায় একটি নীতিগত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো হয়েছে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, জাতীয় সংসদের ৩০০ আসন দলগুলোর সাংগঠনিক শক্তি, প্রার্থীর গ্রহণযোগ্যতা এবং স্থানীয় বাস্তবতার ভিত্তিতে ভাগ করা হবে। এক আসনে এক প্রার্থী দেওয়ার নীতিতে সবাই একমত হয়েছে। কোনো আসনে একাধিক দাবিদার থাকলে যৌথ সমন্বয় কমিটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।
এই সমঝোতায় জামায়াত তুলনামূলকভাবে বেশি আসনে প্রার্থী দেওয়ার দাবি করলেও জোটের স্বার্থে কিছু গুরুত্বপূর্ণ আসনে ছাড় দিতে রাজি হয়েছে বলে জানা গেছে। দলটির একাধিক নেতা মনে করছেন, সংখ্যার চেয়ে সম্মিলিত শক্তি ও রাজনৈতিক বার্তা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
এনসিপির বাড়তি গুরুত্ব
এবারকার সমঝোতায় এনসিপির ভূমিকা বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে। তরুণ নেতৃত্ব, নতুন রাজনৈতিক বয়ান এবং শহরভিত্তিক সমর্থনের কারণে দলটি যুগপৎ আন্দোলনের ভেতরে আলাদা অবস্থান তৈরি করেছে। আলোচনায় অংশ নেওয়া নেতারা বলছেন, এনসিপিকে উপেক্ষা করে বড় কোনো সমঝোতা বাস্তবসম্মত নয়। ফলে দলটির শক্ত অবস্থান থাকা আসনগুলোতে অন্য শরিকরা ছাড় দেওয়ার মানসিকতা দেখিয়েছে।
এনসিপি নেতৃত্বও এই সমঝোতাকে শুধু আসন বণ্টনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চায় না। তাদের লক্ষ্য, এই ঐক্যের মাধ্যমে ভবিষ্যতের বিরোধী রাজনীতির একটি কাঠামো গড়ে তোলা—যেখানে সংসদের ভেতরে ও বাইরে সমন্বিত ভূমিকা থাকবে।
শেষ মুহূর্তের প্রত্যাশা
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির সৈয়দ রেজাউল করিম বলেন, আলোচনা চলছে এবং সময় খুব কম। তবে আলোচনার অগ্রগতি আশাব্যঞ্জক। ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব অধ্যক্ষ হাফেজ মাওলানা ইউনুছ আহমেদ জানান, আজ বা রোববারের মধ্যেই অন্তত যেসব আসনে সমঝোতা চূড়ান্ত হয়েছে, সেগুলোর ঘোষণা আসতে পারে।
সব মিলিয়ে আগামী ২৪ ঘণ্টাকে যুগপৎ আন্দোলনের নেতারা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন। রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন চোখ—রোববারের ঘোষণার দিকেই।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



