ছবি: সংগৃহীত
চট্টগ্রাম বন্দরের নতুন ট্যারিফ কাঠামো নিয়ে হাইকোর্টের দেওয়া স্থগিতাদেশ তুলে নেওয়ার মধ্য দিয়ে দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরের রাজস্ব কাঠামোতে বড় ধরনের পরিবর্তনের পথ এখন পুরোপুরি উন্মুক্ত হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের চেম্বার জজ আদালত গত মঙ্গলবার এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ আদেশ দেন, যার ফলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক) নতুন ট্যারিফ কার্যকর করতে আর কোনো আইনি জটিলতার সম্মুখীন নয়। ইতোমধ্যে বন্দর কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে এই আদেশ কার্যকর করে নতুন ট্যারিফ আদায়ের কাজ শুরু করেছে।
স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার: আদালতের পর্যবেক্ষণ
গত ৯ নভেম্বর হাইকোর্ট চট্টগ্রাম বন্দরের নতুন ট্যারিফ কাঠামো এক মাসের জন্য স্থগিত করেছিলেন এবং কেন এই ট্যারিফ গেজেট বাতিল ঘোষণা করা হবে না— সে বিষয়ে রুল জারি করেছিলেন। তবে রিটের ওপর স্থগিতাদেশ থাকলেও চেম্বার জজ বিচারপতি ফারাহ মাহবুব উচ্চ আদালতের সেই আদেশকে ‘ডিসপোজড অ্যান্ড স্টে ভেকেটেড’ বলে ঘোষণা করেন। এর ফলে হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ আর কার্যকর থাকল না।
চেম্বার জজ আদালত একইসঙ্গে হাইকোর্টকে রুলটি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দ্রুত নিষ্পত্তির নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে দীর্ঘসূত্রতার কারণে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবা যেমন বন্দর পরিচালনা— তা কোনো অচলাবস্থার মুখে না পড়ে।
রিট আবেদন ও পটভূমি
বাংলাদেশ মেরিটাইম ল সোসাইটি (বিএমএলএস) নতুন ট্যারিফ কাঠামোকে ‘অতি মাত্রায় বৃদ্ধি, অপ্রত্যাশিত ব্যয় এবং শিপিং ইন্ডাস্ট্রিকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দেবে’— এমন অভিযোগ তুলে রিট দায়ের করে। তারা জানায় যে:
-
২০২৫ সালের ট্যারিফ গেজেটে গড়ে ৪১ শতাংশ মাশুল বাড়ানো হয়েছে
-
কিছু ক্ষেত্রে বৃদ্ধি ৪০০ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছেছে, যা আমদানি-রপ্তানি ব্যয় বাড়িয়ে দেশের বাণিজ্যে বড় চাপ ফেলতে পারে
১৪ সেপ্টেম্বর ট্যারিফ গেজেট এবং ৩০ সেপ্টেম্বর সার্কুলার জারি হওয়ার পর থেকেই শিপিং কোম্পানি, ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং এজেন্টসহ বিভিন্ন অংশীজনের মধ্যে এ নিয়ে অসন্তোষ দেখা দেয়। এরপর ৯ নভেম্বর হাইকোর্টের বেঞ্চ স্থগিতাদেশ দেন।
বন্দরের অবস্থান: আধুনিকীকরণ ও ব্যয় সমন্বয়ের দাবি
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, নতুন ট্যারিফ কাঠামো বাস্তবায়ন করা সময়ের দাবি। কারণ:
-
বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়ন চলছে
-
বার্থ অপারেশন, ইকুইপমেন্ট, কনটেইনার হ্যান্ডলিং— এসব খাতে খরচ আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে
-
আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে নিয়মিত বিনিয়োগ প্রয়োজন
বন্দর সচিব ওমর ফারুক বলেন, “চেম্বার জজ আদালত স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করায় এখন নতুন ট্যারিফ বাস্তবায়নে আর কোনো বাধা নেই। আমরা ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় সার্কুলার জারি করেছি।”
নতুন আদেশ: বন্দর কর্তৃপক্ষের সার্কুলার
৩০ নভেম্বর চবকের প্রধান অর্থ ও হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার দপ্তর থেকে জারি করা অফিস আদেশে স্পষ্ট জানানো হয়েছে—
-
হাইকোর্টের স্থগিতাদেশসংক্রান্ত নোটিফিকেশন আর কার্যকর নয়
-
সুপ্রিম কোর্টের আদেশ অনুযায়ী ‘চিটাগাং পোর্ট—২০২৫’ শিরোনামে প্রকাশিত নতুন ট্যারিফ গেজেট বহাল রয়েছে
-
১ ডিসেম্বর থেকে বর্ধিত মাশুল আদায় শুরু হয়েছে
সার্কুলার প্রকাশের পর থেকে বন্দর ব্যবহারকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে নতুন হারে ফি জমা দিতে হচ্ছে।
বিএমএলএস-এর প্রতিক্রিয়া
বিএমএলএস সভাপতি মহিউদ্দিন আব্দুল কাদির বলেন, “হাইকোর্টের দেওয়া স্থগিতাদেশ কার্যকর থাকলেও চেম্বার জজ তা প্রত্যাহার করেছেন। এখন রুলটির চূড়ান্ত শুনানির অপেক্ষা। আমরা আইনগত লড়াই চালিয়ে যাব।”
তিনি আরও জানান, বিপুল হারে ট্যারিফ বৃদ্ধির ফলে ব্যবসায়িক ব্যয় যে বাড়বে— তা অনস্বীকার্য। এ কারণে আদালতের চূড়ান্ত রায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বাণিজ্য খাতের প্রতিক্রিয়া ও সম্ভাব্য প্রভাব
বর্ধিত ট্যারিফে আমদানি-রপ্তানি ব্যয়ে চাপ বাড়বে বলে মনে করছেন শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশন, ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার ও সাপ্লাই চেইন সংশ্লিষ্টরা। বিশেষ করে—
-
কনটেইনার হ্যান্ডলিং চার্জ
-
ডেমারেজ ফি
-
স্টোরেজ ফি
-
জেটি চার্জ
এসব ক্ষেত্রে হঠাৎ বৃদ্ধি ব্যবসায়ীদের নতুন খরচের মুখে ফেলবে। তবে বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, দেশের বন্দর সক্ষমতার বিস্তারের জন্য এটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ।
সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তে বন্দর কর্তৃপক্ষ এখন পুরোপুরি আইনি জটিলতা মুক্ত। ফলে ২০২৫ সালের ট্যারিফ কাঠামো আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর হলো।
এখন সামনে আছে—
-
হাইকোর্টে রুলের চূড়ান্ত শুনানি
-
ব্যবসায়ীদের বাস্তব প্রতিক্রিয়া
-
বাণিজ্য প্রতিযোগিতায় সম্ভাব্য প্রভাব
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমুদ্রবন্দর হওয়ায় চট্টগ্রামের এই পরিবর্তন পুরো দেশের আমদানি-রপ্তানি খাতে ছাপ ফেলবে— এমনটাই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
বাংলাবার্তা/এসজে
.png)
.png)
.png)



