ছবি: সংগৃহীত
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের জন্য ‘সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ, ২০২৫’ জারি করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। তার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে স্বাধীন বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠিত হলো। গতকাল রবিবার রাতে এই অধ্যাদেশের গেজেট প্রকাশ করা হয়। তাতে বলা হয়েছে, ‘যেহেতু সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদে নির্বাহী বিভাগ হইতে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণকে রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম মূলনীতি হিসাবে উল্লেখ করা হইয়াছে; যেহেতু সংবিধানের ১০৯ এবং ১১৬ অনুচ্ছেদের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে অধস্তন আদালতের তত্ত্বাবধান, নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলাবিধানসংক্রান্ত বিষয়াদি যথাযথরূপে পালনের জন্য এবং বিচার বিভাগের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় ভূমিকা পালনের জন্য একটি স্বতন্ত্র সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা আবশ্যক এবং উহার কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিয়োগ ও কর্মের শর্তসমূহ সম্পর্কে বিধান প্রণয়ন করা সমীচীন ও প্রয়োজনীয়; যেহেতু আপিল বিভাগের ৭৯/১৯৯৯ নম্বর সিভিল আপিলের রায় বাস্তবায়নের জন্য নির্বাহী বিভাগ হইতে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ বাস্তবায়নকল্পে বিচার বিভাগের জন্য স্বতন্ত্র সচিবালয় প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা রহিয়াছে; এবং যেহেতু সংসদ ভাঙ্গিয়া যাওয়া অবস্থায় রহিয়াছে এবং রাষ্ট্রপতির নিকট ইহা সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হইয়াছে যে, আশু ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় পরিস্থিতি বিদ্যমান রহিয়াছে; সেহেতু সংবিধানের ৯৩(১) অনুচ্ছেদে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে রাষ্ট্রপতি নিম্নরূপ অধ্যাদেশ প্রণয়ন ও জারি করিলেন।
সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশের গেজেট জারির তথ্য জানিয়ে গত রাতে বিজ্ঞপ্তি দেন সুপ্রিম কোর্টের গণসংযোগ কর্মকর্তা মো. শফিকুল ইসলাম। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের পদক্ষেপে গত ২৭ অক্টোবর বিচার বিভাগের জন্য একটি স্বতন্ত্র সচিবালয় গঠনের জন্য একটি খসড়া অধ্যাদেশ প্রস্তাব আকারে পাঠানো হয় সুপ্রিম কোর্ট থেকে। প্রস্তাবের সঙ্গে সচিবালয়ের সাংগঠনিক কাঠামো, কার্যপ্রণালী বিধি (রুলস অব বিজনেস) ও কার্যবণ্টনের প্রস্তাবও পাঠানো হয়। পরে গত ২০ নভেম্বর অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ ‘সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এর চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়।
’ বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, ‘সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ, ২০২৫ জারির মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের ইতিবাচক সহযোগিতায় বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন আজ বাস্তবে রূপ নিল।’ সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র ও বিশেষ কর্মকর্তা মো. মোয়াজ্জেম হোছাইন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এই অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে পৃথক সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠার পথ খুলে গেল। এখন সচিবালয়ে অর্গানোগ্রাম তৈরির পাশাপাশি অন্যান্য প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে। এই অধ্যাদেশের অধিকাংশ ধারা অবিলম্বে কার্যকর করার কথা বলা হয়েছে।
পাশাপাশি কিছু ধারা কার্যকরে গেজেট নোটিফিকেশন জারি করতে হবে।’
তিন মাসের মধ্যে সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠার নির্দেশ ছিল হাইকোর্টের
১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি, পদোন্নতি ও শৃঙ্খলা বিধানের ক্ষমতা ছিল সুপ্রিম কোর্টের কাছে। বিচারকদের নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি এবং ছুটি মঞ্জুরের ক্ষমতা ছিল প্রধান বিচারপতি ও সুপ্রিম কোর্টের হাতে। ১৯৭৫ সালে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে এই ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের কাছ থেকে নিয়ে রাষ্ট্রপতিকে দেওয়া হয়, যা আইন মন্ত্রণালয় বা অন্য কোনো উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে প্রয়োগ করা হতো। ফলে অধস্তন আদালতের বিচারকদের ওপর নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়।
যদিও তখন ১১৬ অনুচ্ছেদে বলা ছিল, রাষ্ট্রপতি ‘সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমে’ এই ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন। পরে ১৯৮৯ সালে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে ১১৬ অনুচ্ছেদের বিধানে আবার পরিবর্তন আনা হয়। এই সংশোধনীতে ‘সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমে’ অংশটি বাদ দিয়ে অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষমতা পুরোপুরি রাষ্ট্রপতির হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। এসব সংশোধনীর অধীনে ২০১৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকার শৃঙ্খলাবিধি প্রণয়ন করে। চতুর্থ ও পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের পরিবর্তিত ১১৬ অনুচ্ছেদ ও এই অনুচ্ছেদের অধীনে ২০১৭ সালে প্রণীত জুডিশিয়াল সার্ভিস (শৃঙ্খলা) বিধিমালার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে গত বছরের ২৫ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের সাত আইনজীবী রিট করেন। রিটে সুপ্রিম কোর্টের জন্য স্বতন্ত্র সচিবালয় প্রতিষ্ঠার নির্দেশনা চাওয়া হয়। প্রাথমিক শুনানির পর গত বছরের ২৭ অক্টোবর হাইকোর্ট রুল দেন। সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ ও এসংক্রান্ত ২০১৭ সালের জুডিশিয়াল সার্ভিস (শৃঙ্খলা) বিধিমালা কেন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয় রুলে। জানতে চাওয়া হয়, কেন সুপ্রিম কোর্টের জন্য স্বতন্ত্র সচিবালয় প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেওয়া হবে না? আইন মন্ত্রণালয়ের দুই সচিব ও সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়। এই রুলে চূড়ান্ত শুনানির পর গত ২ সেপ্টেম্বর রায় দেন উচ্চ আদালত।
রায়ে ১৯৭২ সালের সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ বর্তমান সংবিধানে পুনর্বহালের পাশাপাশি তিন মাসের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের জন্য ‘স্বতন্ত্র সচিবালয়’ প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।
অধ্যাদেশে যা বলা হয়েছে : সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ-২০২৫’-এর ৪ ধারায় বলা হয়েছে, সংবিধানের ২২, ১০৯ ও ১১৬ অনুচ্ছেদের উদ্দেশ্যপূরণকল্পে সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় নামে একটি স্বতন্ত্র সচিবালয় থাকবে। এই ৪ ধারায় আরো সাতটি উপধারা রয়েছে। এসব উপধারায় বলা হয়েছে, এই সচিবালয়ের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ থাকবে প্রধান বিচারপতির হাতে। সচিবালয়ের প্রশাসনিক প্রধান হবেন সচিব। সচিবের মর্যাদা হবে সরকারের সিনিয়র সচিবের মর্যাদার সমান। সুপ্রিম কোর্টের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সচিবের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে কাজ করবেন। সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের কার্যাবলি শিরোনামের ৫ ধারায় বলা হয়েছে, দেশের অধস্তন আদালত, ট্রাইব্যুনালের তত্ত্বাবধান, নিয়ন্ত্রণ এবং প্রয়োজনীয় সব প্রশাসনিক ও সাচিবিক দায়িত্ব পালন করবে এই সচিবালয়। সেই সঙ্গে অধস্তন আদালত প্রতিষ্ঠা, বিলোপ, অধস্তন আদালতের সংখ্যা নির্ধারণ, গঠনের এখতিয়ারও থাকবে এই সচিবালয়ের।
অধ্যাদেশের ৬ ধারায় বলা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় সরকারের যেকোনো মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তর বা অফিসের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারবে। একইভাবে কোনো ব্যক্তি বা সরকারের কোনো মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তরও সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারবে।
থাকবে সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় কমিশন : দেশের বিচার প্রশাসনের উন্নয়ন, বিচার বিভাগের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা ও পরামর্শ দেওয়ার জন্য সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় কমিশন নামে একটি কমিশন থাকবে। কমিশনের চেয়ারপারসন হবেন প্রধান বিচারপতি। কমিশনে থাকবেন আইন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বা উপদেষ্টা, প্রধান বিচারপতি মনোনীত আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারপারসন ও অ্যাটর্নি জেনারেল। সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে সাবেক বিচারক মাসদার হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি তো গেজেটটা দেখিনি। শুনেছি দুইটা ডিজাস্টার হয়েছে। একটা হলো সব জুডিশিয়াল অফিসার সচিবালয়ের আওতায় আসেনি বলে শুনলাম। তা ছাড়া বিচারকদের পরিপূর্ণভাবে অর্থনৈতিক স্বাধীনতাও দেওয়া হয়নি বলে শুনেছি। যদি তা-ই হয়ে থাকে, তবে এ দুটি মারাত্মক অসম্পূর্ণতা।’
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



