
ছবি: সংগৃহীত
মুন্সীগঞ্জের টঙ্গীবাড়িতে স্ত্রী মাহমুদা বেগমকে নির্মমভাবে হত্যা করে তিন সন্তানকে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন রুবেল লস্কর নামের এক ব্যক্তি। এই মর্মান্তিক ঘটনার ১১ দিন পর অবশেষে ঘাতক স্বামীকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব-১১। ঘটনার পর থেকেই ওই ব্যক্তি ছিলেন গা-ঢাকা, অবশেষে বুধবার (১৭ এপ্রিল) মাদারীপুর সদর থানা এলাকায় অবস্থানকালেই তাকে আটক করা হয়।
র্যাব-১১ এর একটি দল গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে মাদারীপুর জেলার সদর থানাধীন ডনোভান সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে থেকে রুবেল লস্করকে গ্রেপ্তার করে। তার বয়স ৪৫ বছর। তিনি মাদারীপুর জেলার রাজৈর থানার মহিষমারী গ্রামের ফজল লস্করের ছেলে।
স্থানীয় সূত্র ও পুলিশ জানায়, ৬ এপ্রিল সকাল ১০টার দিকে মুন্সীগঞ্জের টঙ্গীবাড়ি উপজেলার বালিগাঁও ইউনিয়নের নয়াগাঁও গ্রামের হানিফ মালের ভাড়া বাড়িতে ঘটে এই লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড।
প্রায় এক সপ্তাহ আগে, ২ এপ্রিল, রুবেল তার স্ত্রী মাহমুদা বেগম (৩৮) এবং তাদের তিন সন্তানকে নিয়ে ওই এলাকায় নতুনভাবে ভাড়া বাসায় উঠেছিলেন। স্থানীয়দের চোখে তাঁরা ছিলেন সদ্য আসা এক সাধারণ পরিবার, কিন্তু মাত্র চারদিনের মাথায় ঘটল ভয়াবহ এই ঘটনা।
র্যাব জানায়, পারিবারিক কলহ, পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং কথিত সন্দেহ থেকেই দাম্পত্য কলহ চরমে পৌঁছায়। ঘটনার দিন সকাল ১০টার দিকে তীব্র বাকবিতণ্ডার একপর্যায়ে রুবেল স্ত্রী মাহমুদাকে হত্যা করে। এরপর দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ঘরের দরজার বাইরে ছিটকিনি দিয়ে তিন সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে পালিয়ে যায়।
রুবেল লস্করের আচরণ এবং পুরো পরিবার হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যাওয়ায় স্থানীয়দের সন্দেহ তৈরি হয়। কয়েক ঘণ্টা পর প্রতিবেশীরা ঘরের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ দেখে কৌতূহলী হয়ে ওঠে।
বাড়ির মালিক হানিফ মালেসহ অন্যরা দরজার ছিটকিনি খুলে ভিতরে প্রবেশ করে দেখেন, খাটের ওপর নিথর পড়ে আছেন মাহমুদা বেগম। তার শরীরে ছিল আঘাতের চিহ্ন। সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয়রা পুলিশে খবর দেয়।
খবর পেয়ে টঙ্গীবাড়ি থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে মরদেহ উদ্ধার করে।
পরদিন ৭ এপ্রিল নিহত মাহমুদার বাবা কারী গাউছ ঘরামী বাদী হয়ে টঙ্গীবাড়ি থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় সরাসরি রুবেল লস্করকে একমাত্র আসামি করা হয়।
মামলার পর থেকেই পুলিশ ও র্যাব ঘাতককে ধরতে যৌথভাবে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছিল। প্রথম থেকেই ধারণা করা হচ্ছিল, রুবেল তার পূর্বপরিচিত কোনো স্থানে আত্মগোপন করেছে এবং সন্তানদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে।
র্যাব-১১ জানায়, বুধবার মাদারীপুরের সদর থানা এলাকায় সন্দেহভাজন অবস্থায় ঘুরছিল রুবেল। তাকে শনাক্ত করে তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেপ্তার করা হয়।
পরে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রুবেল স্ত্রী হত্যার দায় স্বীকার করেছে বলে জানায় র্যাব।
এ বিষয়ে টঙ্গীবাড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মহিদুল ইসলাম বলেন, “রুবেল লস্করকে গ্রেপ্তার করে র্যাব আমাদের হেফাজতে হস্তান্তর করেছে। তাকে আদালতে পাঠানো হবে। পাশাপাশি মামলার তদন্ত কার্যক্রমও দ্রুত এগিয়ে নেয়া হচ্ছে।”
ঘটনার পর থেকেই নিহতের তিন শিশু সন্তান বাবার সঙ্গে কোথায় ছিল, কীভাবে ছিল—তা এখনো পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। তবে র্যাবের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সন্তানরা শারীরিকভাবে সুস্থ আছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ শেষে পরিবারের নিকটতম আত্মীয়দের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
এই মর্মান্তিক ঘটনা আবারও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল—গৃহস্থালী কলহ কখনও কখনও কতোটা ভয়ানক পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পারে। পরিবারভিত্তিক সহিংসতা প্রতিরোধে সামাজিক সচেতনতা ও মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা এই ঘটনায় আরও একবার প্রমাণিত হলো।
একজন নারী, একজন মা, শুধু পারিবারিক দ্বন্দ্বের বলি হয়ে নিজের জীবন হারালেন, আর তার সন্তানেরা হারালো জীবনের দুই প্রিয়জনকেই—একজন নিহত, আরেকজন খুনি। এই বেদনার অবসান কোথায়?
এখন অপেক্ষা রইল—এই নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের সুবিচার কবে মিলবে, এবং তিন শিশু সন্তান ফিরে পাবে কি না একটি নিরাপদ আশ্রয়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ