ছবি: সংগৃহীত
আগামীকাল শনিবার ঢাকায় হেফাজতে ইসলামের আয়োজনে একটি মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে, যেখানে তাদের চারটি মূল দাবি নিয়ে প্রতিবাদ জানানো হবে। এর মধ্যে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন বাতিল করা অন্যতম প্রধান দাবি হিসেবে উঠে এসেছে। মহিলা বিষয়ক কমিশনের প্রতিবেদন এবং তার অন্তর্গত কিছু প্রস্তাব ইসলামি আইন এবং সংস্কৃতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ না হওয়ায় হেফাজতে ইসলামের নেতারা তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। তারা মনে করছেন, এই প্রতিবেদন মুসলিম সমাজের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে এবং ইসলামের মৌলিক নীতির পরিপন্থী।
হেফাজতের নেতারা দেশের বিভিন্ন জেলায় সাংগঠনিক সফর করেছেন, তাদের মূল উদ্দেশ্য হলো ঢাকায় আগামীকাল সমাবেশে বিশাল জনসমাগম তৈরি করা। সংগঠনটি ইতিমধ্যেই স্থানীয় মাদ্রাসাগুলিতে গিয়ে সভা ও আলোচনা করে প্রস্তুতি সেরে ফেলেছে। এই মহাসমাবেশের মাধ্যমে তারা সরকারের প্রতি তাদের চার দফা দাবি তুলে ধরবে, যার মধ্যে নারী সংস্কার কমিশন বাতিল, শাপলা চত্বরে 'গণহত্যার' বিচার, এবং ফিলিস্তিন ও ভারতে মুসলমানদের নিপীড়ন বন্ধ করার দাবি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
নারীর সমান অধিকার: ইসলামবিরোধী দাবি?
নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে ইসলামি দলগুলো, বিশেষ করে হেফাজতে ইসলাম, তাতে গভীর অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। এই কমিশনের প্রতিবেদনে কিছু প্রস্তাব রয়েছে, যেমন উত্তরাধিকারী সম্পত্তিতে নারীদের সমান অধিকার, বহুবিবাহ বন্ধের প্রস্তাব, যৌনকর্মীদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি, এবং নারীদের সমান অধিকার দেয়ার মতো বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছেন তারা। হেফাজত নেতারা এই প্রস্তাবগুলোকে সরাসরি ইসলামবিরোধী বলে অভিহিত করেছেন, যা কোরআনের শিক্ষা এবং ইসলামী নীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলে তারা দাবি করছেন।
হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক একে ইসলামবিরোধী পদক্ষেপ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এবং দাবি করেছেন যে এই প্রস্তাবগুলো ইসলামের মূল সত্তার বিরুদ্ধে। তার মতে, "বহুবিবাহ বন্ধের প্রস্তাব সরাসরি ইসলামী শিক্ষা এবং কোরআন বিরোধী, কারণ ইসলাম পুরুষদের দ্বিতীয় বিবাহের অনুমতি দেয়, তবে তা সীমিত এবং সুনির্দিষ্ট শর্তে।" এছাড়া, যৌনকর্মীদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার প্রস্তাবকে তিনি ইসলামের বিরোধিতা বলছেন এবং এমন পদক্ষেপের ফলে পতিতাবৃত্তি আরও উৎসাহিত হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
হেফাজতের প্রতিবাদ ও মঞ্চ
হেফাজতে ইসলামের নেতারা জানাচ্ছেন, এই প্রতিবেদন এবং এর প্রস্তাবনা মুসলিম সমাজের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক হতে পারে। তারা বলছেন, সরকার যদি এই প্রস্তাবনা কার্যকর করার চেষ্টা করে, তবে তা মুসলিমদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক তৈরি করবে, কারণ এতে মুসলিম পরিবার ও সমাজের মৌলিক নীতিগুলো হুমকির মুখে পড়বে।
হেফাজত ইসলামের নেতা আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেন, "এটা একটি পরিকল্পিত আক্রমণ, যা আমাদের সমাজের ঈমান এবং ইসলামী মূল্যবোধের উপর আঘাত।" তিনি আরও বলেন, "আমরা এই কমিশনের প্রতিবেদনকে বাতিল করার দাবি জানাচ্ছি, কারণ এটি আমাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের বিরোধী।"
সমাবেশের উদ্দেশ্য
হেফাজতে ইসলামের নেতারা জানাচ্ছেন, তারা শুধু প্রতিবাদ জানাতে নয়, বরং সরকারের কাছে তাদের দাবি বাস্তবায়ন করতে চাপ প্রয়োগ করতে চান। এই জন্য তারা নির্বাচনের পর সরকার ক্ষমতায় এলে রাজনৈতিকভাবে মামলাগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবহারের আশঙ্কা করছেন এবং দাবি করছেন যে, সরকারের অবস্থা এখনও তাদের দাবিগুলো বাস্তবায়ন করতে সহায়তা করবে।
আজিজুল হক ইসলামাবাদী আরও বলেন, "সরকার যাদের দাবি মানছে, তাদের জন্য কোনো সমস্যা হয় না, কিন্তু আমাদের জন্য কেন হবে? আমরা চাই আমাদের দাবি শুনে সরকার দ্রুত ব্যবস্থা নিক।"
কমিশনের প্রতিবেদন: ইসলামি শিক্ষার প্রতি সম্মান
নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের সদস্য ফাওজিয়া করিম ফিরোজ এই ব্যাপারে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। তিনি বলেন, "আমরা কোনভাবেই ধর্মীয় আইনের প্রতি হস্তক্ষেপ করতে চাইনি। আমাদের প্রতিবেদন শুধুমাত্র সিভিল আইন প্রণয়নের প্রস্তাব দিয়েছে, যা নারী-পুরুষের সমঅধিকার নিশ্চিত করবে এবং এটি ঐচ্ছিক হবে।"
তিনি বলেন, "ধর্মীয় আইন নিয়ে কোনো পরিবর্তন প্রস্তাবিত হয়নি, তবে আমরা মনে করি যে, একটি সিভিল ল তৈরি হলে প্রতিটি নারী তাদের অধিকার পেতে পারে।"
হেফাজতের হুঁশিয়ারি
এদিকে, হেফাজতের শীর্ষ নেতা মামুনুল হক বলেন, "নারী সংস্কার কমিশনের রিপোর্টের প্রস্তাব মুসলমানদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করেছে। আমরা আশঙ্কা করছি, যদি সরকার দ্রুত এই প্রস্তাবনা কার্যকর করার চেষ্টা করে, তবে আমাদের সমাজে বড় ধরনের সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে।"
তিনি আরও বলেন, "আমরা কোনো ধরনের আতঙ্ক সৃষ্টি করতে চাই না, তবে আমাদের আশঙ্কা বাস্তব। সরকার যদি এই ধরনের প্রস্তাবনা বাস্তবায়ন করতে যায়, তাহলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে।"
সমাজে প্রতিক্রিয়া
এই পরিস্থিতি নিয়ে একদিকে সরকারের পক্ষ থেকে নীরবতা লক্ষ্য করা গেলেও, অন্যদিকে সামাজিক মিডিয়া এবং বিভিন্ন জনমত তৈরি হতে শুরু করেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, যদি হেফাজত ইসলামের দাবি মেনে নেওয়া হয়, তবে দেশে নারীদের অধিকার সম্পর্কে সমাজের সংবেদনশীলতা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তবে, কিছু ধর্মীয় পণ্ডিত এই দাবি সমর্থন করছেন এবং তারা মনে করছেন, ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে এই প্রস্তাবনাগুলি গ্রহণযোগ্য নয়।
হেফাজতের মহাসমাবেশ ও তাদের দাবিগুলি শুধু ধর্মীয় বিষয় নয়, বরং বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতাকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করতে পারে। এমনকি, এ ধরনের আন্দোলন আরও বড় আকার ধারণ করলে, তা সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে। তবে, নারীর অধিকার, ইসলামী শিক্ষা, এবং সুশাসনের মধ্যে সঠিক ভারসাম্য রক্ষা করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হতে চলেছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



