ছবি: সংগৃহীত
রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা অপরিবর্তিত রয়েছে। যুক্তরাজ্য থেকে আসা মেডিক্যাল টিমের চিকিৎসকরা তাঁদের কাজ শুরু করেছেন। গতকাল বুধবার রাতে চীন থেকে এসেছে আরো একটি মেডিক্যাল টিম। গত রাতে দেশি ও বিদেশি চিকিৎসকদের সমন্বয়ে গঠিত মেডিক্যাল বোর্ড বৈঠক করেছে।
খালেদা জিয়ার খোঁজ নিতে গতকাল বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে যান প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সন্ধ্যা ৭টা ৭ মিনিটে প্রধান উপদেষ্টার গাড়িবহর হাসপাতাল প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে। এ সময় প্রধান উপদেষ্টাকে স্বাগত জানান বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। পরে তাঁকে নিয়ে চতুর্থ তলায় ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে যান।
সেখানে বিশেষ ব্যবস্থায় মেডিক্যাল বোর্ডের তত্ত্বাবধানে বিএনপি চেয়ারপারসনের চিকিৎসা চলছে।
খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন জানান, সিসিইউতে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসনের শয্যার পাশে কিছুক্ষণ অবস্থান করেন প্রধান উপদেষ্টা। তাঁর সুস্থতা কামনায় তিনি দোয়া করেন। পরে তাঁর স্বাস্থ্যের সর্বশেষ অবস্থা প্রধান উপদেষ্টাকে ব্রিফ করেন ডা. জাফর ইকবাল।
বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান বলেন, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে মেডিক্যাল বোর্ডের প্রধান অধ্যাপক শাহাবুদ্দিন তালুকদার, অধ্যাপক এ জেড এম জাহিদ হোসেন এবং খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর সহধর্মিণী সৈয়দা শর্মিলা রহমানও ছিলেন। প্রধান উপদেষ্টা হাসপাতালে প্রায় আধাঘণ্টা অবস্থান করেন। এরপর তাঁর গাড়িবহর সেখান থেকে বের হয়ে যায়।
অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন গতকাল দুপুরে বলেন, ‘নতুন করে বলার মতো কোনো সিদ্ধান্ত হলে জানানো হবে। এরই মধ্যে যুক্তরাজ্য থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এসে মেডিক্যাল বোর্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন।
রাতে চীনের আরেকটি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক টিম আসবে।’ চেয়ারপারসনের পরিবার ও দলের পক্ষ থেকে গতকাল খালেদা জিয়ার দ্রুত সুস্থতা কামনায় দেশবাসীর মাধ্যমে আল্লাহর দরবারে দোয়া চান তিনি।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, গতকাল সকাল ১০টা ২০ মিনিটে লন্ডন ক্লিনিকের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রিচার্ড বিলে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছেন। দুপুরে চিকিৎসকদলটি হাসপাতালে পৌঁছে এবং চিকিৎসা কার্যক্রমে অংশ নেয়। আগে থেকে মেডিক্যাল বোর্ডের সঙ্গে চীনের একটি চিকিৎসক টিমও কাজ করছে। এ ছাড়া গত রাতে চীন থেকে আরেকটি মেডিক্যাল টিম এসেছে। চার সদস্যের টিমে রয়েছেন চিকিৎসক চি জিয়ানফান, ইয়ান ঝি, ঝং ইউহি ও ম্যাং হং। গত রাত ১০টা ১০ মিনিটে এই চিকিৎসকরা হাসপাতালে পৌঁছেন।
সূত্র জানায়, যুক্তরাজ্যের চিকিৎসকদলটি প্রথমে সিসিইউতে গিয়ে খালেদা জিয়ার বর্তমান শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে। পরে তারা স্থানীয় মেডিক্যাল টিমের সঙ্গে চিকিৎসা পরিকল্পনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে। সিসিইউতে চিকিৎসাধীন খালেদা জিয়ার অবস্থা এখনো সংকটজনক। তবে তিনি চিকিৎসায় সাড়া দিচ্ছেন বলে জানা গেছে।
সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, বিদেশি বিশেষজ্ঞ টিম দীর্ঘমেয়াদি রোগ ব্যবস্থাপনা, ঝুঁকির বর্তমান মাত্রা, অর্গান সাপোর্ট এবং পরবর্তী করণীয় বিষয়ে উন্নত চিকিৎসা পরিকল্পনা প্রণয়নে কাজ করবে। তারা মেডিক্যাল বোর্ডের সঙ্গে সমন্বয় করে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ এবং বর্তমান চিকিৎসা অগ্রগতির মূল্যায়ন করবে। প্রথম দিনের কাজের অংশ হিসেবে বিশেষজ্ঞদলটি খালেদা জিয়ার বিভিন্ন জটিলতার ক্লিনিক্যাল নোট, সর্বশেষ টেস্ট রিপোর্ট এবং ব্যবহৃত সাপোর্ট সিস্টেমের ডকুমেন্টেশন পর্যালোচনা করেছে।
খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিস, লিভার সিরোসিস, কিডনির জটিলতাসহ নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন। শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে গত ২৩ নভেম্বর তাঁকে এভারকেয়ার হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। তাঁর ফুসফুসের সংক্রমণ অবস্থার অবনতি হলে গত ২৭ নভেম্বর থেকে ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে নিয়ে চিকিৎসকরা তাঁকে বিশেষ ব্যবস্থায় নিবিড়ভাবে চিকিৎসা দিচ্ছেন। অধ্যাপক শাহাবুদ্দিন তালুকদারের নেতৃত্বে বিশেষজ্ঞদের একটি মেডিক্যাল বোর্ড খালেদা জিয়ার চিকিৎসা কার্যক্রম তদারকি করছে। বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, খালেদা জিয়ার অবস্থা সংকটাপন্ন।
দলীয় সূত্র জানায়, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, চীন, কাতার, সিঙ্গাপুর, পাকিস্তান, ভারতসহ বন্ধুপ্রতিম অনেক দেশের সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধান চিকিৎসা কার্যক্রমে সহযোগিতা দিতে আগ্রহী। অনেক দেশের পক্ষ থেকেই নিয়মিত যোগাযোগ করা হচ্ছে।
গত মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে ডাক্তাররা যে চিকিৎসা দিচ্ছেন, সেই চিকিৎসা বেগম খালেদা জিয়া গ্রহণ করতে পারছেন অথবা আমরা যদি বলি উনি মেইনটেইন করছেন। আমরা এই সংকটময় মুহূর্তে আপনাদের মাধ্যমে দেশবাসীর কাছে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে উনার সুস্থতার জন্য দোয়া চাই। দেশবাসীর দোয়া, সারা পৃথিবীর অনেক মানুষের উনার প্রতি ভালোবাসা এবং দোয়ার কারণে হয়তো বা উনি এই যাত্রায় সুস্থ হয়ে উঠবেন বলে আমরা আশা করি।’
ডা. জাহিদ আরো বলেন, ‘খালেদা জিয়ার মেডিক্যাল বোর্ড যদি মনে করে উনাকে ট্রান্সফার করার প্রয়োজন এবং উনি ট্রান্সফারেবল, তাহলে যথাযথ সময়ে চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়া হবে। আমাদের সব প্রস্তুতি আছে। কিন্তু সর্বোচ্চটা মনে রাখতে হবে যে রোগীর বর্তমান অবস্থা এবং সর্বোপরি মেডিক্যাল বোর্ডের পরামর্শের বাইরে কোনো কিছু করার সুযোগ এই মুহূর্তে আমাদের নেই।’
গত কয়েক দিনের মতো গতকালও রাজধানীসহ সারা দেশে গণতন্ত্রের মাতা খালেদা জিয়ার সুস্থতা কামনায় দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়।
এভারকেয়ারের কাছে হেলিকপ্টার ওঠানামা করবে, বিভ্রান্ত না হতে অনুরোধ : এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন খালেদা জিয়াকে সরকার ‘অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’ ঘোষণা করার পর গত মঙ্গলবার দুপুর থেকে এসএসএফ নিরাপত্তা দেওয়া শুরু করেছে। এসএসএফের নিরাপত্তা প্রটোকল অনুযায়ী আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালের কাছের দুটি মাঠে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টার পরীক্ষামূলকভাবে অবতরণ-উড্ডয়ন করবে। তাই এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেওয়া এক বিজ্ঞপ্তিতে বিভ্রান্ত না হতে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
এভারকেয়ার হাসপাতালের সামনে বিজিবি মোতায়েন, নেতাকর্মীর ভিড় : এভারকেয়ার হাসপাতালের সামনে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যদের মোতায়েন করা হয়েছে। সার্বিক নিরাপত্তার জন্য গতকাল এই বিজিবি মোতায়েন করা হয়। দায়িত্বরত বিজিবি কর্মকর্তারা জানান, সার্বিক নিরাপত্তার জন্য হাসপাতালের সামনে দুই প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। এক প্লাটুন হাসপাতালের গেটে দায়িত্ব পালন করছে। আরেক প্লাটুন টহলে রয়েছে।
অন্যান্য দিনের মতো গতকাল সকাল থেকে এভারকেয়ার হাসপাতালে সামনে ভিড় করতে থাকেন বিএনপির নেতাকর্মী। তবে পুলিশের যে ব্যারিকেড দেওয়া রয়েছে, তার বাইরে তাঁরা অবস্থান করছেন।
এভারকেয়ার হাসপাতালের সামনে আসা নেতাকর্মীদের অনেকে বলছেন, এখানে ভিড় না করতে কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশনা আছে। তার পরও তাঁদের মন মানছে না। তাই সবকিছু উপেক্ষা করে হাসপাতালের সামনে ছুটে এসেছেন তাঁরা।
খালেদা জিয়ার জন্য দোয়া করলেন ইসলামী আন্দোলনের নায়েবে আমির : খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নিতে এভারকেয়ার হাসপাতালে আসেন ইসলামী আন্দোলনের নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ ফয়জুল করীম (শায়খে চরমোনাই)। এ সময় তিনি বেগম খালেদা জিয়ার আরোগ্য ও নেক হায়াত কামনা করেন। তিনি সেখানে উপস্থিত বিএনপি নেতাদের সঙ্গে কথা বলেন। ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলে চিকিৎসার সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত হন। বেগম খালেদা জিয়ার দ্রুত আরোগ্য ও নেক হায়াত কামনা করে মহান আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করেন তিনি।
এ সময় সৈয়দ ফয়জুল করীম বলেন, ‘তিনি (খালেদা জিয়া) একজন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ। জাতির এই ক্রান্তিকালে তাঁর উপস্থিতি প্রয়োজন। বিএনপির নেতাকর্মী ও তাঁর পরিবারের প্রতি আমাদের সহমর্মিতা জানাচ্ছি।’
দেশের বিভিন্ন স্থানে সুস্থতা কামনায় দোয়া : খালেদা জিয়ার সুস্থতা কামনায় গতকাল দেশের বিভিন্ন জেলার বিভিন্ন এলাকায় কোরআন খতম ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে গাজীপুর, কুমিল্লা, চুয়াডাঙ্গা, পঞ্চগড়, সুনামগঞ্জ, বগুড়ার গাবতলী, আদমদীঘি, ফরিদপুর শহর ও ভাঙ্গা, নেত্রকোনার দুর্গাপুর এবং সাভারের আশুলিয়া।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



