ছবি: সংগৃহীত
লাখো মানুষের অংশগ্রহণে জানাজা শেষে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবরের পাশেই চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শহীদ শরিফ ওসমান বিন হাদি। গতকাল শনিবার বিকেল ৪টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে কবির সমাধিসৌধ প্রাঙ্গণে যথাযথ মর্যাদায় তাঁর দাফন সম্পন্ন হয়। দাফনকালে সেখানে শোকাবহ পরিবেশের সৃষ্টি হয়। উপস্থিত স্বজন, সহযোদ্ধা ও অনুসারীদের অনেকে কান্নায় ভেঙে পড়েন।
শেষবারের মতো বিদায় জানাতে গিয়ে আবেগ সংবরণ করতে পারেননি অনেকে। সমাধিসৌধ প্রাঙ্গণজুড়ে নেমে আসে গভীর শোকের ছায়া। এর আগে দুপুর আড়াইটায় জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় হাদির জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে পরিণত হয় জনসমুদ্র।
জানাজায় অংশ নিতে আসা মানুষ জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় প্রবেশ করে। তবে স্থান সংকুলান না হওয়ায় সবাই সে সুযোগ পায়নি। মানিক মিয়া এভিনিউজুড়ে কাতারবদ্ধ হয়ে জানাজায় অংশ নেয় লাখো মানুষ। ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত এ জানাজায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতা, সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তি, সহযোদ্ধা, শুভানুধ্যায়ীসহ সাধারণ মানুষের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো।
জানাজায় ইমামতি করেন হাদির বড় ভাই আবু বকর সিদ্দিক। এ সময় কান্না, দীর্ঘশ্বাস ও নীরব প্রার্থনায় পুরো এলাকা পরিণত হয় এক শোকাবহ নিস্তব্ধ প্রাঙ্গণে।
জানাজার আগে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, ‘ওসমান হাদি, তোমাকে আমরা বিদায় দিতে আসিনি। তুমি আমাদের বুকের মধ্যে আছো।
বাংলাদেশ যত দিন টিকে থাকবে, তুমি আমাদের মধ্যে থাকবে।’ ধর্মবিষয়ক উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেন সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দিয়ে শহীদ হাদির জীবনপঞ্জি পাঠ করে শোনান। তিনি হাদির জন্য সবার কাছে দোয়া চান।
আমার ভাইয়ের বদলা নিতে এসেছি : ইনকিলাব মঞ্চের সদস্যসচিব
জানাজার আগে বক্তব্য দেন ইনকিলাব মঞ্চের সদস্যসচিব আবদুল্লাহ আল জাবের। তিনি বলেন, ‘আমরা এখানে কি কান্নার জন্য এসেছি? আমরা এখানে কিসের জন্য এসেছি? আমার ভাইয়ের রক্তের বদলা নেওয়ার জন্য আজ এই জানাজায় দাঁড়িয়েছি।’
হাদির হত্যার বিচারের দাবিতে কোনো ধরনের সহিংসতার আহ্বানে সাড়া না দেওয়ার আহবান জানিয়ে জাবের বলেন, ‘ইনকিলাব মঞ্চ থেকে সব ধরনের সিদ্ধান্ত জানানো হবে।’ আক্রমণের এক সপ্তাহ পেরোলেও হাদির হামলাকারীদের গ্রেপ্তার না হওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী খোদা বখস চৌধুরীকে নেওয়া পদক্ষেপ জনগণকে জানাতে হবে। নইলে তাঁদের পদত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
বিচার যেন প্রকাশ্যে দেখতে পারি : ওসমান হাদির বড় ভাই
ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান বিন হাদির হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রকাশ্যে করার দাবি জানিয়েছেন তাঁর বড় ভাই আবু বকর সিদ্দিক। হাদির জানাজায় ইমামতি করার আগে তিনি এ দাবি জানান।
আবু বকর সিদ্দিক বলেন, ‘ওসমান হাদি স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার বার্তা দিয়ে গেছেন। তাঁর মাত্র আট মাসের একটি সন্তান রয়েছে, যার নাম রাখা হয়েছে ‘ফিরনাস’। আজ তার সন্তানের মুখের দিকে তাকানোও কঠিন হয়ে পড়েছে।’
তিনি বলেন, ‘রাজধানীতে প্রকাশ্যে জুমার নামাজের পর খুনিরা গুলি করে পালিয়ে যায়। সাত থেকে আট দিন পেরিয়ে গেলেও যদি তারা পার পেয়ে যায়, এর চেয়ে লজ্জার কিছু জাতির জন্য আর হতে পারে না। খুনিরা যদি পাঁচ থেকে সাত ঘণ্টার মধ্যে সীমান্ত পেরিয়ে যেতে পারে, তাহলে তারা কিভাবে গেল—এ প্রশ্ন জাতির কাছে রেখে গেলাম। আমার কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই।’
হাদির বড় ভাই আরো বলেন, ‘ওসমান হাদি শহীদ হওয়ার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করতেন। আল্লাহ হয়তো তাঁকে শহীদি মর্যাদা দিয়েছেন, কিন্তু তাঁর হত্যার বিচার প্রকাশ্যে দেখতে চাই। সাত দিনেও কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় পরিবার চরম দুশ্চিন্তায় রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা ওসমান হাদির জন্য দোয়া করি, তাঁর স্ত্রী ও সন্তানের জন্য দোয়া করি। তাঁর সন্তানকে যখন বাবাকে দেখানোর জন্য কোলে করে আনা হয়, তখন মনে হয় সে আর কোনো দিন জানবে না তার বাবা কেমন ছিলেন। ওসমান হাদি আর ফিরে আসবেন না। ওসমান, তুমি দেখে যাও, লক্ষ লক্ষ জনতা আজ তোমার জন্য পাগল।’ এরপর হাদির জানাজা পরিচালনা করেন তিনি।
এদিন সকালে ময়নাতদন্তের জন্য হাদির মরদেহ শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে নেওয়া হয়। পরে গোসলের জন্য মরদেহ জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে নেওয়া হয়। সেখান থেকে মরদেহ জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় আনা হয়। মরদেহ বহনের সময় হাদির পরিবারের সদস্য, সহযোদ্ধা ও শুভানুধ্যায়ীরা উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে গতকাল ভোর থেকেই মানিক মিয়া এভিনিউয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষজন ছুটে আসে হাদিকে শেষবারের মতো বিদায় জানাতে। সকাল ১১টার দিকে মানিক মিয়া এভিনিউ, সংসদ ভবনের দক্ষিণাংশের দুটি মাঠ ও আশপাশের এলাকা পরিণত হয় জনসমুদ্রে। সকাল ১১টা ২০ মিনিটে খুলে দেওয়া হয় সংসদ ভবনের প্রধান গেট। পরে সংসদ ভবনের চারপাশ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। আসাদগেট, ফার্মগেট, খামারবাড়িসহ আশপাশের এলাকায় মানুষের ঢল নামে।
এ সময় ‘আমরা সবাই হাদি হব, যুগে যুগে লড়ে যাব’, ‘হাদি ভাইয়ের রক্ত বৃথা যেতে দেব না’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে দেখা যায়। জানাজায় অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের প্রায় সব সদস্য এবং বিভিন্ন কূটনৈতিক মিশনের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী, ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক আমিনুল হক, জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান, সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, সদস্যসচিব আখতার হোসেন, ইসলামী চিন্তাবিদ শায়খ আহমাদুল্লাহ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন, নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল এম নাজমুল হাসানও জানাজায় অংশ নেন।
জানাজায় অংশগ্রহণের পর এক প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘হাদির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে কেউ যেন রাজনৈতিক ফায়দা না নিতে পারে, সে বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা এই বর্বর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করেছি, নিন্দা জানিয়েছি। পতিত ফ্যাসিবাদী শক্তি এবং নির্বাচনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী কোনো শক্তি এই ঘটনাকে ব্যবহার করে রাজনৈতিকভাবে ফায়দা নিতে না পারে এবং নির্বাচন পেছানো বা বানচাল করার মতো কোনো ষড়যন্ত্র করতে না পারে, সে জন্য আমরা দেশের মানুষকে সজাগ থাকার আহবান জানাচ্ছি।’
এদিকে হাদির জানাজা শেষে সেখানে উপস্থিত একদল লোক সংসদ ভবনে প্রবেশের চেষ্টা করে। তবে সেখানে অবস্থানরত সেনা সদস্যরা তাদের বাধা দেন এবং সংসদের ভেতর প্রবেশের গেটগুলোর সামনে অবস্থান নেন। সংসদে প্রবেশের চেষ্টাকারীরা বেশ কিছু সময় সেনা সদস্যদের কর্ডনের সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল। তবে সেখান থেকে ধীরে ধীরে তারা সরে শাহবাগের দিকে চলে যায়।
হাদির দাফনের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান, উপ-উপাচার্য অধ্যাপক মামুন আহমেদ, আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
শহীদ ওসমান হাদির দাফন শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বলেন, ‘শহীদ শরিফ ওসমান হাদি হত্যাকাণ্ড বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়, এটি একটি আদর্শকে থামিয়ে দেওয়ার পরিকল্পিত অপচেষ্টা ।’ ঢাবি উপাচার্য বলেন, ‘শরিফ ওসমান হাদি একটি ব্যক্তির নাম নয়, এটি একটি আদর্শের নাম। এই আদর্শ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়বে এবং কোনো হত্যাকাণ্ড দিয়ে একে থামিয়ে দেওয়া যাবে না।’
হাদির দাফন ঘিরে সতর্ক ছিল পুলিশ-বিজিবি-সোয়াটসহ যৌথ বাহিনী
ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদির দাফনকে কেন্দ্র করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী বাড়তি নিরাপত্তাব্যবস্থা নেয় রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায়। গতকাল শনিবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এ সময় ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি তদারকি করেন।
গতকাল সকাল থেকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় ছিল আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশের কবরস্থানে নেওয়া হয় কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা। কবরস্থানের ভেতর ও আশপাশের এলাকায় বিপুলসংখ্যক পুলিশ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), সোয়াট টিম ও সাদা পোশাকে ডিবি সদস্য মোতায়েন করা হয়।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রমনা বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) মাসুদ আলম বলেন, হাদির জানাজা ও দাফনকে ঘিরে এলাকাজুড়ে কঠোর নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা হয়। যেকোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, হাদির জানাজাকে কেন্দ্র করে সংসদ ভবন ও আশপাশের এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য মোতায়েন করা হয়। এ সময় পুরো সংসদ ভবন এলাকা ও এর আশপাশের এলাকায় নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হয়। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরা সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে ছিল। নিরাপত্তার স্বার্থে মানিক মিয়া এভিনিউয়ে প্রবেশের প্রতিটি পয়েন্টে বসানো হয় নিরাপত্তা চৌকি।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



