ছবি: সংগৃহীত
গণ–অভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে দেশের দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে নজিরবিহীন গতি এসেছে। রাষ্ট্রীয় প্রশাসন, রাজনৈতিক অঙ্গন এবং করপোরেট জগতের বহু বছর ধরে অরক্ষিতভাবে বেড়ে ওঠা দুর্নীতির নেটওয়ার্ক ভেঙে দেওয়ার অভ্যাসে নামার পর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) গত ১১ মাসে রীতিমতো রেকর্ড সাফল্য অর্জন করেছে। মামলার সংখ্যা, চার্জশিট, সম্পদ ক্রোক, অর্থ ফ্রিজ, অনুসন্ধান—সব সূচকেই অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে নতুন মাত্রা স্থাপন করেছে সংস্থাটি।
এই সময়ের মধ্যে দুদকের জালে ধরা পড়েছেন প্রায় সাড়ে তিন হাজার (৩,৫০০) ভিআইপি আসামি—যাদের বড় অংশই ক্ষমতাসীন সরকারের সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, উপদেষ্টা, শীর্ষ ব্যবসায়ী, প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটাই প্রথমবার, যখন একই বছরে এত বড় পরিসরে প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে মামলা, অনুসন্ধান, সম্পদজব্দ ও চার্জশিট একসঙ্গে পরিচালিত হয়েছে।
দুদকের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে দুর্নীতির অভিযোগে ৫৪১টি মামলা বা এজাহার দায়ের করা হয়েছে। এসব মামলায় আসামির সংখ্যা ২,২৯৭ জন।
একই সময়ে বিভিন্ন মামলায় চার্জশিট দেওয়া হয়েছে ৩৪৯টিতে, যেখানে আসামি ১,২০৩ জন। মামলা ও চার্জশিট মিলিয়ে মোট ৩,৫০০-এরও বেশি ব্যক্তি দুদকের ফাঁদে পড়েছেন।
দুদকের কর্মকর্তারা বলছেন, এত স্বল্প সময়ে এত বড় সংখ্যক মামলা ও চার্জশিট দাখিল দেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন।
মামলা দায়েরের পাশাপাশি দুর্নীতিবাজদের নতুন অভিযোগ আমলে নেওয়াতেও গত ১১ মাসে দুদক ব্যস্ত সময় পার করেছে। জানুয়ারি–নভেম্বর সময়ে নতুনভাবে অনুসন্ধানে নেওয়া হয়েছে ১,০৬৩টি অভিযোগ।
এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যক্তি, ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতাদের উদ্দেশে ৩৮২টি সম্পদ বিবরণী নোটিশ জারি করেছে দুদক—যা সাধারণত বড় আকারের অবৈধ সম্পদ, মানি লন্ডারিং বা ক্ষমতার অপব্যবহারের ইঙ্গিত পাওয়া গেলে জারি করা হয়।
অন্যদিকে অভিযোগ যাচাই-বাছাই শেষে ১১ মাসে ৮২টি মামলায় ফাইনাল রিপোর্ট (এফআর) এবং ৩৯টি অভিযোগ পরিসমাপ্তি দেওয়া হয়েছে, যেখানে মোট ২৩০ জনকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
দুদকের কার্যক্রম আগের দুই বছরের সঙ্গে তুলনা করলে ২০২৫ সালের সাফল্য কতটা বিস্ময়কর, তা পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়—
২০২৪ সালের জানুয়ারি–নভেম্বর
-
অভিযোগ অনুসন্ধানে নেওয়া হয়েছিল মাত্র ৪৩৯টি
-
মামলা হয়েছিল ৩২৮টি
-
চার্জশিট হয়েছিল ৩৪৫টি
-
নভেম্বরে কমিশন না থাকায় নতুন অনুসন্ধান বা মামলা হয়নি
২০২৩ সালে
-
অভিযোগ অনুসন্ধানে নেওয়া হয়েছিল ৮৪৫টি
-
মামলা ৪০৪টি
-
চার্জশিট ৩৬৩টি
-
বিপুল ১৩,৫৭৯টি অভিযোগ পরিসমাপ্তি (অর্থাৎ দুর্নীতি পাওয়া যায়নি)
এই দুই বছরের তুলনায় ২০২৫ সালে মামলা, চার্জশিট, অনুসন্ধান—সব ক্ষেত্রেই কয়েকগুণ বৃদ্ধি ঘটেছে।
দুদকের সাড়ে তিন হাজার ভিআইপি আসামির তালিকায় রয়েছেন সাম্প্রতিক সময়ে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার বোন শেখ রেহেনা, ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, বোনের ছেলে রাদওয়ান মুজিব ও মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক।
এছাড়া সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান শামসুল আলম, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়েদুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, সাবেক মন্ত্রী দীপু মনি, হাসানুল হক ইনু, আনিসুল হক, রাশেদ খান মেনন, খন্দকার মোশাররফ হোসেন, নাজমুল হাসান পাপন, টিপু মুনশি, জাহিদ মালিক, নসরুল হামিদ বিপুসহ আওয়ামী সরকারের অধিকাংশ সিনিয়র মন্ত্রী–এমপিই এখন দুদকের মামলার আসামি।
এর বাইরে দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী গ্রুপগুলোর মালিক ও পরিচালক—এস আলম গ্রুপ, নাসা গ্রুপ, সামিট গ্রুপ, বেক্সিমকো, নাবিল গ্রুপ, সিকদার গ্রুপ, অ্যাননটেক্স, বিসমিল্লাহ, জেমকন—সবাই একযোগে তদন্তের মুখে।
দুদক কর্মকর্তারা বলছেন—“বাংলাদেশে কখনো এত বড় করপ্ট নেটওয়ার্ক একসঙ্গে আইনের আওতায় আসেনি।”
দুদকের অন্যতম বড় সাফল্য হলো অবৈধ সম্পদ ও পাচার করা অর্থ ক্রোক ও ফ্রিজ করে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে আনা।
২০২৫ সালের জানুয়ারি–নভেম্বর
-
দেশে ক্রোক: ৩,৪৫৭ কোটি ৮৩ লাখ টাকা
-
দেশে ব্যাংক/আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ফ্রিজ: ২২,২২৬ কোটি ৭৯ লাখ টাকা
-
বিদেশে ফ্রিজ: ৩২৮ কোটি ৩৮ লাখ টাকা
মোট: প্রায় ২৬,০১৩ কোটি টাকা ক্রোক ও ফ্রিজ—যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
২০১৯–২০২৪ পাঁচ বছরে মোট ক্রোক হয়েছিল মাত্র ৩,৪৫০ কোটি
২০২৪ সালে পুরো বছরে ক্রোক হয়েছিল মাত্র ৩৬১ কোটি
অর্থাৎ ২০২৫ সালে মাত্র ১১ মাসেই আগের পাঁচ বছরের ৭ গুণ বেশি সম্পদ উদ্ধার করা হয়েছে।
দুদকের বিচারাধীন মামলার নিষ্পত্তিতেও গতি এসেছে—
-
নিষ্পত্তি: ২৪৯টি মামলা
-
দণ্ডপ্রাপ্ত: ১২৬টি মামলা
-
খালাস: ১২৩টি
-
জরিমানা আদায়: ৫,০৫৮ কোটি টাকা
-
বাজেয়াপ্ত: ৩২১ কোটি টাকা
এ ছাড়া ১১ মাসে ১১,৬৩০টি অভিযোগ এলেও মাত্র ৯৬০টি অভিযোগ অনুসন্ধানে গ্রহণ করা হয়েছে—যার অর্থ, অপ্রয়োজনীয় বা ভিত্তিহীন অভিযোগ বাদ দিয়ে বাস্তবসম্মত মামলায় জোর দেওয়া হয়েছে।
দুদকের কমিশনার (তদন্ত) মিঞা মুহাম্মদ আলি আকবার আজিজী বলেন— “দুদকের দন্ত ও নখ আছে এবং এটিকে আরও তীক্ষ্ণ করার প্রয়োজন রয়েছে। দুদক যথার্থ আইনি শক্তির অধিকারী। বিচার কার্যক্রম দ্রুত করার জন্য বিশেষ আদালত প্রতিষ্ঠা জরুরি।”
তিনি আরও বলেন, গণ–অভ্যুত্থানের পর জনগণের প্রত্যাশা অনেক বেড়েছে, তাই দুর্নীতিবিরোধী লড়াইয়ে সংস্থাকে আরও বেশি কার্যকর ও আক্রমণাত্মক হতে হবে।
গত ১১ মাসের পরিসংখ্যান স্পষ্ট করে যে—বাংলাদেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের শিথিলতা ভেঙে এখন কঠোরতম অবস্থানে গেছে দুদক। যে দুর্নীতি বহু বছর ধরে রাজনৈতিক সুরক্ষা ও প্রশাসনিক ছত্রচ্ছায়ায় অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিল, এখন সেই সিস্টেম ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে।
রাষ্ট্রীয় তদন্ত সংস্থার দাবি—এ অভিযান থেমে নেই; বরং আরও বড় নেটওয়ার্কের বিরুদ্ধে অভিযান শিগগিরই শুরু হবে।
বাংলাবার্তা/এসজে
.png)
.png)
.png)



