ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আগামী বছর থেকে দেশের ভ্যাট প্রশাসনে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে। ভ্যাট নিবন্ধন (BIN) ছাড়া কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে না দেওয়ার মতো কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রহমান খান। মঙ্গলবার (৯ ডিসেম্বর) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে এনবিআর ভবনে ভ্যাট দিবস ও ভ্যাট সপ্তাহ উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এই গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন।
সভায় এনবিআর চেয়ারম্যান জানান, আগামী বছর এমন একটি আধুনিক ও ডিজিটাল মেকানিজম চালু করা হবে, যার ফলে ভ্যাট নিবন্ধন ছাড়া কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে না। এই ব্যবস্থাটি এমনভাবে নকশা করা হচ্ছে যাতে ব্যবসা করার প্রতিটি ধাপেই ভ্যাট নিবন্ধন বাধ্যতামূলক হয়ে ওঠে—হোক তা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা, ট্রেড লাইসেন্স নেওয়া, এলসি খোলা, আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম, সরকারি টেন্ডারে অংশগ্রহণ বা আর্থিক লেনদেন।
এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, “আমরা এমন একটি সিস্টেম আনছি যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ব্যবসাগুলোকে ভ্যাট নিবন্ধনের আওতায় নিয়ে আসবে। আগামী এক থেকে দুই বছরের মধ্যে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ লাখ প্রতিষ্ঠানকে এই নেটওয়ার্কে আনা হবে। দেশে যত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে তার তুলনায় বর্তমানে ভ্যাটদাতার সংখ্যা অত্যন্ত কম।”
সরকারের অন্যতম বড় রাজস্ব উৎস ভ্যাট হলেও দেশে এখনো ভ্যাট নেট অস্বাভাবিকভাবে ছোট। বর্তমান নিবন্ধিত ভ্যাটদাতা মাত্র ৬ লাখ ৪৪ হাজার—যা দেশের মোট সক্রিয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ব্যবসা-বাণিজ্যের আকার ও এলাকা বিবেচনায় এই সংখ্যা আরও ৫–৬ গুণ বেশি হওয়া উচিত বলে এনবিআরের অভ্যন্তরীণ বিশ্লেষণ বলছে।
এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, “আমাদের দেশের প্রকৃত ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিমাণ, বিভিন্ন জরিপের তথ্য, স্থানীয় সরকারি নিবন্ধনের সংখ্যা—সবকিছু বিবেচনায় দেখা যায় যে ভ্যাট নেটে থাকা উচিত অন্তত ৩০ থেকে ৪০ লাখ প্রতিষ্ঠান। সেখান থেকে এখনো আমরা বহুদূরে। তাই ভ্যাট নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করার এই নতুন উদ্যোগ অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।”
চলতি ভ্যাট সপ্তাহ উপলক্ষে এনবিআর বিশেষ অভিযান ও সচেতনতামূলক কর্মসূচি চালাচ্ছে। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই অন্তত ১ লাখ নতুন ব্যবসাকে নিবন্ধনের আওতায় আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
চেয়ারম্যান বলেন, “চলতি মাসেই এক লাখ নতুন প্রতিষ্ঠান নিবন্ধিত হবে বলে আশা করছি। এতে সামগ্রিক ভ্যাট সংগ্রহ বেড়ে যাবে, একই সঙ্গে ব্যবসাগুলোকেও একটি স্বচ্ছ ও নিয়মিত প্রক্রিয়ার মধ্যে আনা সম্ভব হবে।”
তিনি স্বীকার করেন যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো ভ্যাট সংগ্রহের মূল মাধ্যম—ব্যবসায়ীরা। তাদের অনেকেই এখনো হয় নিবন্ধন নিচ্ছেন না, অথবা নিবন্ধন নিয়ে নিয়মিত রিটার্ন দিচ্ছেন না।
তিনি বলেন, “যারা ভ্যাট প্রদান করেন বা যাদের হাত দিয়ে সরকার ভ্যাট পায়—মূলত সেই ব্যবসায়ীদের ভ্যাট নেট অত্যন্ত ছোট। এটি অর্থনীতির জন্য অনুৎপাদনশীল ও রাষ্ট্রের রাজস্ব প্রবাহের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।”
অনুষ্ঠানে আমদানি করা মোবাইল ফোনে কর কমানোর বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, রাষ্ট্রের স্বার্থই সর্বোচ্চ বিবেচ্য। কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সরকার, নীতিনির্ধারক ও সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
তিনি স্পষ্ট করে বলেন, “এটা সম্পূর্ণ সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত। এনবিআর এখন কর অব্যাহতি দেওয়ার ক্ষমতা রাখে না, কারণ সরকার কর অব্যাহতি নীতিমালা চালু করেছে। তাই এনবিআরের পক্ষে আলাদা করে কর কমানো বা অব্যাহতি দেওয়া সম্ভব নয়।”
যদি রাষ্ট্র জনস্বার্থে প্রয়োজন মনে করে, তাহলে স্বল্প সময়ের জন্য কর সমন্বয় করা সম্ভব বলে তিনি জানান। পরবর্তী সংসদ বসে তারপর স্থায়ীভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
চেয়ারম্যান বলেন, “যদি মনে করি দেশের বৃহত্তর স্বার্থে কোনো কর সমন্বয় দরকার, এবং রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকেরা যদি মত দেন—আমরা অবশ্যই ইতিবাচকভাবে তা বিবেচনা করব। তবে সবকিছুর কেন্দ্রেই আছে রাষ্ট্রের স্বার্থ।”
এনবিআরের এই নতুন উদ্যোগগুলো মূলত জাতীয় অর্থনীতিকে একটি স্বচ্ছ, ডিজিটাল ও জবাবদিহিমূলক কাঠামোর মধ্যে আনার অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে। ভ্যাট নিবন্ধন বাধ্যতামূলক হলে ব্যবসার আনুষ্ঠানিক খাত আরও বড় হবে, সরকার রাজস্ব বাড়াতে পারবে এবং অর্থনৈতিক নীতি আরও শক্তিশালী হবে।
নতুন মেকানিজম চালুর মাধ্যমে ভ্যাট নেট দ্রুত বিস্তৃত হবে এবং দীর্ঘদিন ধরে ভ্যাট ফাঁকি দিয়ে পরিচালিত ব্যবসাগুলোকে আইনি কাঠামোর মধ্যে আনা সম্ভব হবে। দেশের অর্থনীতি আনুষ্ঠানিকতার দিকে আরও এক ধাপ অগ্রসর হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
বাংলাবার্তা/এসজে
.png)
.png)
.png)



