ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নিয়ন্ত্রাধীন কাস্টম ও ভ্যাট ক্যাডারের যুগ্ম কমিশনার (জেসি) মো জাহিদুল ইসলামের ২ কোটি টাকার ঘুষ দাবির তদন্ত প্রতিবেদনের বিপরীতে কোন আইনগত কার্যক্রয় গৃহিত হয়নি বলে জানা গিয়েছে। ২০২১ সালের ১৫ ফ্রেবুয়ারি তদন্ত কমিটি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্যকে ( শুল্ক ও ভ্যাট প্রশাসন) তদন্ত প্রতিবেদনে ঘুষ দাবির কথোপকথনের অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করলেও এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি তখন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড(এনবিআর)।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে তখনকার কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট খুলনার কমিশনার (বর্তমানে ঢাকা উত্তর ভ্যাট কমিশনারেটের কমিশনার) মো সামসুল ইসলামকে তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনে ঘুষ দাবির অভিযোগটি প্রমাণিত হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়ে চুড়ান্তভাবে প্রমাণিত করার লক্ষ্যে অডিওটি ফরেনিসক করার সুপারিশ করলেও এ বিষয়ে আর কোন কার্যক্রম নেওয়া হয়নি। কিন্তু এই কর্মকর্তা অবৈধ ক্ষমতার প্রভাব বিস্তার করে কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে দেননি।
বাংলাবার্তার কাছে তদন্ত কমিটির অনুলিখন এবং ঘুষ দাবির অডিও ক্লিপ সংরক্ষিত রয়েছে।
জানা যায়, আলোচ্য ক্ষেত্রে ঘুষ লেনদেনের দরকষাকষিতে ব্যর্থ হওয়ার ৪ মাস পরে জাহিদুল ইসলাম কমিশনারকে ভ্যাট ফাঁকির বিষয়টি অবহিত করেন এবং প্রিভেনটিভ কার্যক্রম পরিচালনা সকল কাগজপত্র জব্দ করেন। যেখানে ভ্যাট ফাঁকির বিষয়টি প্রথমে কমিশনারকে অবহিত করার কথা সেটা না করে তিনি ঘুষ লেনদেনের দরকষাকষি করেন। উক্ত সময়ে কোন রাজস্ব ফাঁকি হলে তার দায়ভার জাহিদুলের ওপর পড়ে।
এমনকি বাংলাবার্তার অনুসন্ধানে জানা গিয়েছে, তখন এনবিআরের কিছু অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজসের কারণে ঘুষ দাবির অভিযোগটি তদন্তে প্রমাণিত হলেও বেঁচে যায় জাহিদুল।
তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী জানা যায়, ঘুষ চাওয়া ব্যক্তি পাবনার কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট বিভাগের ডেপুটি কমিশনার এবং বিভাগীয় কর্মকর্তা মো. জাহিদুল ইসলাম (বর্তমানে তিনি যুগ্ম কমিশনার)। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইউনিভার্সাল গ্রুপের কাছে তিনি ঘুষ দাবি করেন। ঘুষ দাবি করা কাস্টম ও ভ্যাট বিভাগের আরও এক কর্মকর্তা হচ্ছে, তখন পাবনার রাজস্ব কর্মকর্তা শাহাজুর রহমান।
তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী এবং অডিও রেকর্ড অনুযায়ী কিছু কথোপকথনের অংশ হচ্ছে, ডেপুটি কমিশনার(বর্তমানে যুগ্ম কমিশনার)মো জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমি আপনাদেরকে সার্বিকভাবে সব কিছুতেই সেভ করে দিব। এখানে আমি ও কমিশনার স্যার নতুন। আমাদের উভয়ের সঙ্গে সুন্দর সম্পর্ক রেখে আপনারা সুন্দরভাবে ব্যবসা পরিচালনা করে যাবেন। আপনাদের কোনো সমস্যা হবে না।’ (কথাগুলো বলেন ইউনিভার্সাল গ্রুপের প্রতিনিধিকে)।
এসময় রাজস্ব কর্মকর্তা বলেন,সিদ্ধান্ত ১ কোটি টাকা। কাল না,কাল বন্ধ। ১৫/০৪/২০২০ তারিখে নিয়ে আসবেন। আপনিও বলবেন না আমিও বলবো না।
তখন জাহিদুল ইসলাম বলেন, ১৫/০৪/২০২০ তারিখ বুধবার দিয়ে দিবেন।
এসময় ইউনিভার্সাল গ্রুপের সিওও মো শাহজাহান বলেন,বিষয়টি বিবেচনার জন্য অনুরোধ করছি।
এরপর মো জাহিদুল ইসলাম আবার বলেন, আপনারা যেহেতু দ্বিতীয়বার আমার চেম্বারে এসেছেন নিশ্চয়ই আপনারা সিদ্ধান্ত নিয়ে এসেছেন।
তখন আবারও ইউনিভার্সাল গ্রুপের সিওও মো শাহজাহান বলেছেন,স্যার আপনার সম্মানে আমরা এসেছি। ম্যাডাম আমাদেরকে আপনার নিকট পাঠিয়েছে।
এই কথা বলার পর ডিসি জাহিদুল ইসলাম(বর্তমানে যুগ্ম কমিশনার) বলেন, পুণরায় আর আসার দরকার নেই। ১ কোটি টাকাই ফাইনাল।
পরবর্তীতে ভ্যাট সুপার মো শাহাজুল বলেন, শাহজাহান ভাই যা হচ্ছে এটাই ফাইনাল। পুণরায় ডিসিকে সান্তনা দিয়ে বলেছেন, বিষয়টি আমি দেখছি। আপনি শান্ত হন। যেভাবেই হোক পার্টি থেকে ব্যবস্থা করে দিব।
এ ঘটনায় প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোহানী হোসেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অভিযোগ দায়ের করেন জাহিদুল ইসলামসহ তিনজনের বিরুদ্ধে। সঙ্গে সেদিনের ঘুষ চাওয়ার অডিও রেকর্ডটিও সংযুক্ত করে দেন। এরপর তখন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশে অভিযোগের তদন্তে নামে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড।
অনুসন্ধানে জানা যায়, পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার ভাঙ্গুড়াবাজার গ্রামের মৃত হাজি মো. রিয়াজুল ইসলামের ছেলে জাহিদুল ইসলাম। ২৯তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ২০১১ সালে সহকারী কমিশনার (কাস্টম) হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি।
এদিকে অভিযোগে বলা হয়,পাবনার কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট বিভাগের ডেপুটি কমিশনার এবং বিভাগীয় কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত মো. জাহিদুল ইসলাম। চাকরির বেতন ছাড়া আর কোনো উপার্জন না থাকলেও কয়েক বছরে ২০০ বিঘা জমির মালিক বনে গিয়েছেনতিনি। এছাড়াও অল্প দিনেই কোটিপতি বনে গেছেন তার শ্বশুর ও ভাগ্নে। চাকরির টাকায় পরিবারের খরচ চালিয়ে এত অল্প সময়ে জাহিদুলের এমন ধনী হওয়ার কথা জেনে দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছিলেন অনেকেই।
এনবিআরের তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, অভিযুক্ত কর্মকর্তা মো জাহিদুল ইসলাম ও রাজস্ব কর্মকর্তা মো শাহাজুলকে লিখিত ও মৌখিক বক্তব্য প্রদানের জন্য তিনবার সময় দেওয়ার পরও তারা জবাব না দিয়ে তদন্ত কমিটিকে অসহযোগিতা করেন।
এদিকে বাংলাবর্তার অনুসন্ধান বলছে, চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনারেট ও ঢাকা উত্তর কমিশনারেটে থাকাকালীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে অডিট ও প্রিভেনটিভের নামে শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন জাহিদ বলে অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে। এসব সম্পত্তি তার শ্যালক বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স হিসেবে পাঠানো হয়েছে বলে জাহিদুল দাবি করলেও বাস্তবে সম্ভব কিনা সেটা অনুসন্ধানের দাবি রাখে।
এ বিষয়ে জানতে বাংলাবার্তার পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয় তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ঢাকা উত্তর ভ্যাট কমিশনারেটের কমিশনার মো সামসুল ইসলামের সঙ্গে। কিন্তু একাধিকবার তার ব্যক্তিগত মোবাইল নাম্বারে কল দেওয়া হলেও তিনি ফোনটি রিসিভ করেননি। ফলে তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
অপরদিকে ঘুষ চাওয়া অভিযুক্ত কর্মকর্তা মো জাহিদুল ইসলামের মোবাইল ফোনে কল দেওয়া হলে তার ফোনটি বন্ধ পাওয়া গিয়েছে।
.png)
.png)
.png)



