বিএনপি। ছবি : সংগৃহীত
নির্বাচন ঠেকাতে ব্যর্থ হয়ে চরম অস্বস্তিতে থাকা বিএনপিকে আরও বেশি অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলো।
আমেরিকা, ব্রিটেন, কানাডা, জার্মানি, ফ্রান্স, স্পেন, সুইজারল্যান্ড, নরওয়ে, সুইডেনসহ ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোর কাছ থেকে শেখ হাসিনার সরকারের স্বীকৃতির খবরে বিএনপি যখন মর্মাহত, ঠিক তখন কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে বিএনপির সঙ্গে দফা-রফা করতে চাচ্ছে পশ্চিমারা।
দায়িত্বশীল সূত্র থেকে জানা গেছে, পশ্চিমা কূটনীতিকদের পরামর্শেই বিএনপি হরতাল-অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচি থেকে সরে এসেছে। কিন্তু, এতেও সন্তুষ্ট হতে পারছে না পশ্চিমাবিশ্ব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলো বিএনপির কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত চাচ্ছে। এসব ব্যাপারে দ্রুত সিদ্ধান্ত না নিলে বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক আর টেনে নেবে না তারা।
জানা গেছে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের কূটনীতকরা বিএনপির শীর্ষ নেতাদের বলেছেন, তারেক রহমান যেহেতু দেশে অবস্থান করছেন না, সেহেতু বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে তার সম্যক ধারাণা নাই। সে কারণে তার কাছ থেকে আসা সিদ্ধান্তগুলো বাস্তসম্মত হয় না। দলের ওপর তার একক কর্তৃত্ব থাকায় তার সিদ্ধান্তের বাইরেও কেউ যেতে পারে না। এসব কারণে বিপুল জনসমর্থন থাকার পরও বিএনপির আন্দোলন সফলতার মুখ দেখে না।
তাছাড়া একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা, অর্থ পাচারসহ তারেক রহমান একাধিক মামলায় দণ্ডিত। এ কারণে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক মহলে তার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। এই ধরনের একজন বিতর্কিত ব্যক্তিকে এই মুহূর্তে বিএনপির নেতৃত্বে থাকা উচিত নয়। বিএনপির নেতৃত্বে এমন একজন ব্যক্তি থাকা উচিত যিনি দেশে অবস্থান করছেন এবং অপেক্ষাকৃত ক্লিন ইমেজের।
কিন্তু, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের এই পরামর্শ আমলে নিচ্ছে না বিএনপি। একই ইস্যুতে ২০১৩ সালে বিএনপি তাদেরকে (পশ্চিমা) যেভাবে ফিরিয়ে দিয়েছিল এবারও তারা (বিএনপি) একই অবস্থান নিয়েছে। নেতৃত্ব পরিবর্তন বা বিকল্প নেতৃত্ব খোঁজার ঝুঁকি নিতে চাইছে না বিএনপির শীর্ষ নেতারা। তারা আপাতত তারেক নেতৃত্ব মেনে নিয়ে সংকট উত্তরোণের চেষ্টা করছে।
বিএনপির জন্য পশ্চিমাদের দ্বিতীয় মেসেজটা হচ্ছে- কোনো অবস্থাতেই সন্ত্রাস এবং সহিংসতার রাজনীতি মেনে নেবে না তারা। ট্রেনে আগুন, বাসে অগ্নিসংযোগসহ জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলনের ব্যাপারে পশ্চিমারা জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। বিএনপিকে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে সহিংস আন্দোলনের পথ থেকে সরে না এলে পশ্চিমাদের সমর্থন হারাবে তারা। দাবি আদায়ের ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করা, দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করা, জান-মালের ক্ষতি সাধন পশ্চিমা নীতির সঙ্গে যায় না। সুতরাং পরিস্থিতি যত জটিলই হোক বিএনপিকে সহিংস আন্দোলন থেকে সরে আসতে হবে।
দলীয় সূত্রমতে, পশ্চিমাদের এই অবস্থানের প্রতি একাত্মতা পোষণ করেই হরতাল-অবরোধ, অসহযোগ আন্দোলন থেকে সরে এসেছে বিএনপি। আপাতত তারা সভা-সমাবেশ, মানবন্ধন, আলোচনা সভা, প্রতিবাদ মিছিল, কালোপতাকা মিছিলের মতো নিরুত্তাপ কর্মসূচি পালন করছে। যে পশ্চিমাদের ভরসায় ক্ষমতা লাভের স্বপ্ন দেখছে, সেই পশ্চিমাদের মতের বিরুদ্ধে যেতে চায় না বিএনপি। অবশ্য তারেক ইস্যুতে পশ্চিমাদের মতকে অগ্রাহ্য করতে হচ্ছে দলটিকে।
তৃতীয়ত, গণতন্ত্রের জন্য হা-হুতাশ করলেও বিএনপির অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র চর্চার সীমিত পরিসর নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলো। বছরের পর বছর কাউন্সিল না করা, যাকে খুশি তাকে পদায়ন করা, ঠুনকো ইস্যুতে দলের পরীক্ষিত নেতাদের মুখস্ত প্রেস রিলিজের মাধ্যমে বরখাস্ত করা, শীর্ষ নেতৃত্ব নিয়ে গঠনমূলক সমালোচনার সুযোগ না রাখাসহ বিভিন্ন বিষয়ে জোরাল আপত্তি জানিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা বিশ্বের কূটনীতিকরা।
সম্প্রতি বিএনপির সঙ্গে এক বৈঠকে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র চর্চার পরামর্শ দিয়েছে পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলো। দলের মধ্যে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা এবং গণতান্ত্রিকভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াকে উৎসাহিত করার ব্যাপারে জোর দিয়েছেন তারা। বৈঠকে অংশ নেওয়া এক মার্কিন কূটনীতিক বিএনপির শীর্ষ নেতাদের কাছে জানতে চেয়েছে বিএনপিতে কীভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়? অসহযোগ আন্দোলন বা অন্যান্য আন্দোলনের কর্মসূচি বিএনপি কীভাবে গ্রহণ করল?
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, এই সব প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি বিএনপির নেতারা। এতেই তারা (বিদেশি কূটনীতিক) বুঝে নিয়েছেন বিএনপিতে সিদ্ধান্ত গৃহীত হচ্ছে একক ব্যক্তির ইচ্ছায় এবং অন্য কারও মতামত সেখানে গুরুত্ব পাচ্ছে না। দলের সবাই যে কেবল ‘জ্বি হুজুর’, ‘জ্বি হুজুর’ ভূমিকায় থাকেন, এই বিষয়টি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো পছন্দ করছে না। তারা পরিষ্কার করে বলেছেন, দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র চার্চার পরিসর বাড়াতে হবে। সবাইকে কথা বলার সুযোগ দিতে হবে। সবার মতকে গুরুত্ব দিতে হবে।
চতুর্থত, যে বিষয়টি নিয়ে বিদেশি মিত্ররা বিএনপিকে চাপে রেখেছে, সেটি হল জামায়াতসহ উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর সঙ্গে বিএনপির চিরকালীন সম্পর্ক। স্বাধীনতাবিরোধী এবং উগ্র-ধর্মান্ধগোষ্ঠীর সঙ্গে অতিরিক্ত সম্পর্কের কারণেই ২০০১-২০০৬ শাসন আমলে বাংলাদেশম নামক রাষ্ট্রকে জঙ্গীবাদী রাষ্ট্রের তকমা লাগিয়ে দিয়েছিল বিএনপি। ১০ ট্রাক অস্ত্র, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, ৬৪ জেলায় সিরিজ বোমা হামলা, ব্রিটিশ হাই-কমিশনারের ওপর বোমা নিক্ষেপ, সাবেক এমপি-মন্ত্রীদের বোমা মেরে হত্যার ঘটনা বেমালুম ভুলে যায়নি পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলো। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে জামায়াত ও উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর সঙ্গে বিদ্যমান সম্পর্ক চিরতরে ছিন্ন করার পরামর্শ দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ কয়েকটি দেশ।
তারা বলছে- বিএনপির মতো একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল উগ্র মৌলবাদী এবং কট্টর রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে পারে না। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদল বিএনপি নেতাদের কাছে জানতে চেয়েছেন জামাতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক কি আগের জায়গায় আছে? জবাবে বিএনপি নেতারা বলার চেষ্টা করেছেন, জামাতের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু তাদের এই ব্ক্তব্য বিশ্বাসযোগ্য হয়নি পশ্চিমাদের কাছে। তারা এ ব্যাপারে পরিষ্কার একটা ধারণা পেতে চায়। কারণ, ২০১৮ সালের নির্বাচনেও জামায়াতের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি করেছে বিএনপি। এখনও তলে তলে জামায়াতের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক বজায় রেখে চলছে বিএনপি।
পঞ্চমত, পশ্চিমা বিশ্ব মনে করে- নির্বাচনের আগে সরকারের সঙ্গে সমঝোতা ও সংলাপের বিষয়টি নাকচ করে দিয়ে সংকট উত্তরণের পথ রুদ্ধ করেছে বিএনপি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা বিশ্ব বারবার সংলাপে বসার আহ্বান জানালেও বিএনপি তাতে রাজি হয়নি। তারা সাফ জানিয়ে দিয়েছে- পদত্যাগ না করলে এবং তত্ত্বাবধায়ক মেনে না নিলে সরকারের সঙ্গে কোনো সংলাপ হবে না। বিএনপির এই অবস্থান ভালো চোখে দেখেনি গণতান্ত্রিক বিশ্ব।
এমন পরিস্থিতিতে পশ্চিমা বিশ্বের পরিষ্কার কথা, রাজনৈতিক সমঝোতা এবং সংলাপের ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব দেখাতে হবে বিএনপিকে। সাম্প্রতিককালের বৈঠকগুলোতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকরা জানতে চেয়েছেন সরকার যখন সমঝোতা বা সংলাপের আহ্বান জানিয়েছিল তখন তারা (বিএনপি) কেন সেই আহ্বানে সাড়া দেয়নি, কেন তারা সমঝোতার প্রস্তাবে রাজি হয়নি? এ প্রশ্নেরও কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি বিএনপি নেতারা।
এমতাবস্থায় পশ্চিমা বিশ্বের পরিষ্কার কথা, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সংকট উত্তরণের সুযোগ থাকলে, সেই সুযোগ গ্রহণ করতে হবে বিএনপিকে। এ ক্ষেত্রে আর কোনো গোঁয়ার্তুমি চলবে না। পেছন থেকে কেউ কু-পরামর্শ দিলে, সেটা এড়িয়ে যেতে হবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মঈন খান বাংলাবার্তাকে বলেন, ‘মিত্র দেশগুলো এ ব্যাপারে বরাবরই বলে আসছে। কিন্তু আমাদেরও তো নিজস্ব নীতি এবং কৌশল আছে। আমরা তো তার বাইরে যেতে পারব না।’
বাংলাবার্তা/এআর