ছবি: বাংলাবার্তা
খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে প্রায় ছয় বছর ধরে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আছেন তারেক রহমান। তিনিই দলের একক ক্ষমতার অধিকারী। কিন্তু দলের বড় একটি অংশে তারেক রহমানের একক কর্তৃত্ব এবং অনেক সিদ্ধান্ত নিয়ে আপত্তি রয়েছে। বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে তারেক রহমান একজন নেতিবাচক চরিত্র হিসেবেই পরিণত হয়ে আসছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খালেদা জিয়ার অবর্তমানে রাজনীতিতে তারেক রহমানের সামনে চ্যালেঞ্জ ছিল দুইটি। প্রথমত, বাবার হাতে গড়া এবং মায়ের পরিশ্রমে দাঁড়িয়ে যাওয়া দল বিএনপিতে নিজের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানো। দ্বিতীয়ত, ক্ষমতার রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ দেশি-বিদেশি মহলে নিজের অনিবার্যতা প্রমাণ করা। কিন্তু, লন্ডনের আয়েশি জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়া তারেক রহমান ক্যাসিনো, জুয়া, রেস্টুরেন্ট বা পার্কে ঘুরে-ফিরেই সময় পার করছেন। ভেতর এবং বাইরের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ তো দূরের কথা, গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয় দুইটিকে কখনও আমলেই নেননি তিনি। ফলে দেশি–বিদেশি গুরুত্বপূর্ণ মহলে তারেক রহমান এখনও গ্রহণযোগ্যতার জায়গায় যেতে পারেননি। এর অনিবার্য ফল হিসেবে ক্ষমতার রাজনীতি থেকে বিএনপি অনেক দূরে রয়ে গেছে।
বিএনপির একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে জানা গেছে, আজ থেকে দশ বছর আগে ২০১৪ সালের নির্বাচন সামনে রেখে খালেদা জিয়ার সঙ্গে বিশেষ এক বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন ও ভারতসহ বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিশ্বসংস্থা, সংগঠন এবং রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা। তারা বেগম খালেদা জিয়াকে এই মর্মে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, যে কোনো মূল্যে ২০১৪ সালের নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ করার জন্য যা যা প্রয়োজন, সব করবে তারা। এ জন্য খালেদা জিয়াকে একটা শর্ত পূরণ করতে হবে। সেটি হল— বিএনপি ক্ষমতায় গেলে ক্ষমতার কাঠামোর বাইরে রাখতে হবে ২১ আগস্ট বোমা হামলার অন্যতম আসামি তারেক রহমানকে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, সেদিন আন্তর্জাতিক মহলের এই শর্ত মেনে নিতে পারেননি বেগম খালেদা জিয়া। ফলে, কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই ওই মিটিং শেষ হয়। মিটিংয়ে অংশ নেওয়া বিএনপির দুইজন শীর্ষ নেতা চরম ক্ষোভ এবং হতাশা নিয়ে মিটিং ত্যাগ করেন। বিদেশি কূটনীতিকরাও যে যার গন্তব্যে চলে যান।
দলের অভ্যন্তরে আলোচনা আছে— মূলত তারপর থেকেই ক্ষমতা কাঠামোর বাইরে চলে যায় বিএনপি। ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় সংসদের বাইরে থাকতে হয় দলটিকে, ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়েও ভোটের আগেই হেরে বসে তারা। সে সময় খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে ভোটে যাওয়া বিএনপির দুর্গতি বাড়িয়ে দেয় তারেক রহমানের মনোনয়ন বাণিজ্য। প্রার্থী দেওয়ার ক্ষেত্রে তার একক কর্তৃত্ব এবং নির্বাচনের দিন দুপুর ১২টার পর দলের সব প্রার্থীকে নির্বাচন বর্জনে বাধ্য করায় কাঙ্ক্ষিত মাত্রার চেয়েও ভয়াবহ খারাপ ফলাফলের সম্মুখীন হতে হয় বিএনপিকে। আর এবার তারেক রহমানের বাড়াবাড়ির কারণেই ভোটে যেতে পারেনি বিএনপি। যদিও তার নির্দেশ উপেক্ষা করে বিএনপির অন্তত ৩৪ জন নেতা তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন।
তারেকের সিদ্ধান্তের বাইরে গেলে নিস্তার নেই
খুলনা জেলা ও মহানগর কমিটি গঠন নিয়ে তারেক রহমানের একক কর্তৃত্ব ও স্বেচ্ছাচারিতায় আপত্তি তোলায় ২০২১ সালের ২৫ ডিসেম্বর নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে বিএনপির খুলনা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
সে বছর ৯ ডিসেম্বর খুলনা মহানগর বিএনপির সভাপতি পদ থেকে নজরুল ইসলাম মঞ্জু ও সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মনিকে বাদ দিয়ে বিএনপির আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। খুলনা মহানগর কমিটির নতুন আহ্বায়ক করা হয় শফিকুল আলমকে।
অভিযোগ ওঠে, এই শফিকুল আলম তারেক রহমানের খাস লোক। তাই, কোনো আলোচনা ছাড়াই নেতা নির্বাচনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে তোয়াক্কা না করে ৪৪ বছর ধরে বিএনপি করে আসা নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে ছুড়ে ফেলে শফিকুল আলমকে নেতৃত্বে আনা হয়।
কমিটি থেকে বাদ পড়ায় ১৪ ডিসেম্বর খুলনা প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন নজরুল ইসলাম। তিনি কমিটি পুনর্গঠনের দাবি জানান। এর দুইদিন পর দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে নজরুল ইসলামকে তিন দিনের মধ্যে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় বিএনপি। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ওই নোটিশের জবাব দেওয়ার পরও ২৫ ডিসেম্বর তাকে বহিষ্কার করা হয়।
তারেক রহমানের উপস্থিতিতে এক ভার্চ্যুয়াল সভায় দল পরিচালনায় ‘লোকাল কমান্ডার’ ঠিক করার প্রস্তাব করেছিলেন কুমিল্লা উত্তর জেলা বিএনপির সভাপতি মঞ্জুরুল আহসান মুন্সী। মুন্সীর ‘লোকাল কমান্ডার’ ঠিক করার প্রস্তাবের ফল ভালো হয়নি। তাকে শায়েস্তা করতে তার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দ্রুত তুলে আনা হয় অপেক্ষাকৃত তরুণ আবদুল আউয়ালকে (২০২১ সালের জুনে তিনি করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যান)। এলাকার রাজনীতিতে মুন্সীর গুরুত্ব কমাতে আউয়ালকে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়েছিল।
এ ধরনের ভিন্ন ভিন্ন ঘটনায় পটুয়াখালীতে কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন চৌধুরী, নোয়াখালী–১ আসনে (চাটখিল–সোনাইমুড়ী) দলের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মাহবুব উদ্দিন খোকন, ভোলায় কেন্দ্রীয় নেতা নাজিমউদ্দিন আলমসহ অনেককেই চাপে রেখেছিলেন তারেক রহমান। কোথাও ছাত্রদল, কোথাও যুবদলের নেতাদের দিয়ে এলাকায় বিকল্প নেতৃত্ব দাঁড় করিয়ে সিনিয়র নেতাদের শায়েস্তা করার চেষ্টা চালিয়েছেন তিনি। দলের সিনিয়র ও বর্ষীয়ান নেতাদের অনেককে তারেক রহমান পছন্দ করেন না। তার ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের কারণে দলে নবীণ এবং প্রবীণদের মধ্যে বিরোধ লেগেই থাকে। ফলে, সরকার বিরোধী আন্দোলনে কাঙ্ক্ষিত ফল পায় না বিএনপি।
তারেকের মনোনয়ন বাণিজ্য ও কমিটি পুনর্গঠনে স্বেচ্ছাচারিতা
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, এবার যেমন নির্বাচনে না যাওয়ার ব্যাপারে তারেক রহমানের একক কর্তৃত্ব দায়ী গতবার তেমনি নির্বাচনের ভরাডুবির জন্যও তারেক রহমান দায়ী। গতবার বিএনপির মনোনয়ন বোর্ডের একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত ছিল বিতর্কিতদের মনোনয়ন না দেওয়ার। কিন্তু রফিকুল ইসলাম (বকুল), মিয়া নুরুদ্দিন (অপু), সাইফুল আলম (নীরব) ও এস এম জাহাঙ্গীর হোসেনকে (উপ-নির্বাচনে) মনোনয়ন দেওয়া হয়। এ ছাড়া প্রায় অর্ধশত আসনে মনোনয়ন পরিবর্তন করা হয়। এসব তারেক রহমান এককভাবে করেছিলেন বলে অভিযোগ দলটির সিনিয়র নেতাদের।
এ কারণে, ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের মনোনয়ন নিয়ে অনেকের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়। ক্ষোভ থেকেই বিএনপি ছাড়েন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও দলের ভাইস চেয়ারম্যান এম মোরশেদ খান। সেবার সিনিয়র নেতাদের বারবার অনুরোধের পরও এম মোরশেদ খানকে চট্টগ্রাম-৮ (বোয়ালখালী-চান্দগাঁও) আসনের মনোনয়ন দেননি তারেক। সেখানে মনোনয়ন পান চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান।
দলের মাঠ পর্যায়ের নেতাদের অভিযোগ, বর্তমানে মাঠপর্যায়ে দল পুনর্গঠনেও তারেক স্বেচ্ছাচারিতার বলি হচ্ছে অনেকেই। তারেক রহমানের হস্তক্ষেপ ছাড়া বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কোনো কমিটিই হয় না। কমিটি করার আগে তিনি নিজস্ব লোকদের দিয়ে নেতা বাছাই করেন। এতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যোগ্যতার চেয়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের অনুগতরা প্রাধান্য পান। দুই বছর আগে খুলনার মহানগর কমিটি পুনর্গঠনে এমনটিই ঘটেছিল। সেখানে নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে বাদ দিয়ে মহানগরের আহ্বায়ক করা হয় শফিকুল আলমকে।
শাহজাহন ওমর, শওকত মাহমুদ দল ছাড়েন তারেকের কারণে
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে যাচ্ছেতাই আচরণ করেন তারেক রহমান। পান থেকে চুন খসলেই সিনিয়র নেতাদের শোকজ করেন তিনি। তার এ কাজে সহযোগিতা করেন দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
এক বক্তব্যের জের ধরে ২০২১ সালে বিএনপির প্রভাবশালী নেতা সাবেক মন্ত্রী স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। অথচ এ ব্যাপারে সে সময় দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কোনো আলোচনা হয়নি। শুধু তাই নয়, ২০২০ সালে দলের ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ ও শওকত মাহমুদকে শোকজ করেন তারেক রহমান। ২০২২ সালে এক বক্তব্যের জের ধরে অধুনা বিএনপি ছেড়ে আসা ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর বীর উত্তমকে শোকজ করেন তিনি।
দলীয় সূত্রমতে, সরকারের চাপে শাহজাহান ওমর আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়েছেন— এমন প্রচারণা থাকলেও মূলত, দলে তারেক রহমানের স্বেচ্ছাচারিতা, সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার এবং কথায় কথায় শোকজের কারণেই দল ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন শাহজাহান ওমর। অপেক্ষায় ছিলেন মোক্ষম সময়ের। নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের কাছ থেকে গ্রিন সিগনাল পাওয়া মাত্র তিনি নৌকার প্রার্থী হন। যাওয়ার আগে তিনি প্রকাশ্যে বলে যান, ‘এখন যারা বিএনপি চালায়, তাদের সঙ্গে রাজনীতি করা সম্ভব না।’
বিএনপির আরেক ভাইস চেয়ারম্যান প্রখ্যাত সাংবাদিক শওকত মাহমুদও দল ছেড়েছেন তারেক রহমানের স্বেচ্ছাচারিতা আর দুর্ব্যবহারের কারণে। গত তিন বছরে একাধিকবার তাকে শোকজ করেন তারেক রহমান। সর্বশেষ গত বছর ১৬ মার্চ রাজধানী বনানীর এক হোটেলে ন্যাশনাল কমিটি ফর সিভিল রাইটস জাতীয় ইনসাফ কায়েম কমিটির এক সুধী সমাবেশ ও নৈশভোজের অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে শওকত মাহমুদকে বহিষ্কার করেন তারেক রহমান। এ বহিষ্কারাদেশের আগে দলের মহাসচিবসহ সিনিয়র নেতাদের কোনো মতামত নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে তারেকের বিরুদ্ধে। কারণ, যে অনুষ্ঠানে যাওয়ার কারণে শওকত মাহমুদকে বহিষ্কার করা হয়, সে অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের সবাই বিএনপির শুভাকাঙ্ক্ষি এবং সরকারের সমালোচক। কেবল মাত্র তারেকের পছন্দ-অপছন্দ এবং ব্যক্তিগত ভালো লাগা-মন্দ লাগার কারণে শওকত মাহমুদকে বহিষ্কার করা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, এভাবে তারেক রহমানের অনেক সিদ্ধান্তই বিএনপির জন্য বুমেরাং হয়েছে। তার একগুয়েমি ও স্বেচ্ছাচারিতার কারণে দলের ঐক্য নষ্ট হয়েছে। সিনিয়র নেতারা নিষ্ক্রিয় হয়ে আছেন। যখন বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের উচিত ছিল দলের নবীন-প্রবীণ সবাইকে এক করে দলকে সংগঠিত করা, ঠিক তখন তারেক তার উল্টোটা করেছেন। তারেক রহমানের অনেক সিদ্ধান্ত ও কর্মকাণ্ড নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশার জন্ম দিয়েছে। বিএনপিতে বিভক্তি তৈরি হয়েছে।
অবশ্য এসব ব্যাপারে বিএনপির সিনিয়র নেতারা মুখ খুলতে ভয় পান। জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে কথা বলে পদ হারাতে চান না কেউ।
দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মঈন খান বাংলাবার্তাকে বলেন, ‘তারেক রহমানের নেতৃত্ব নিয়ে বিএনপিতে কোনো ঝামেলা নেই। বরং তার নেতৃত্বে দলটি এখনও ঐক্যবদ্ধ আছে। তাকে নিয়ে যারা নেতিবাচক প্রচারণা চালায়, তারা মূলত তার প্রতিপক্ষ। আর প্রতিপক্ষের নেতিবাচক প্রচারণায় রাজনীতিবিদদের তেমন কিছু যায় আসে না।’
বাংলাবার্তা/এসএ/এসকে/এমপি