ছবি: বাংলাবার্তা
ট্রান্সজেন্ডার মতবাদটি হঠাৎ সৃষ্টি হওয়া বন্যার মতো কোনো আপদকালীন সমস্যা নয়। বরং এটি সমকামিতাকে নরমালাইজেশনের আন্তর্জাতিক মিশনের অন্যতম একটি প্রজেক্ট। তাছাড়া সমাজ ও রাষ্ট্রে আরও বহু সমস্যা সৃষ্টিকারী একটি মানসিক ব্যাধির নাম হচ্ছে ট্রান্সজেন্ডারবাদ। ভয়াবহ এ ফিতনা নিয়ে লুকোচুরির কিছু নেই। লজ্জা ও সংকোচ প্রকাশের আর সময় নেই। পশ্চিমা বিশ্বের এই আবর্জনা এখন আমাদের দেশে শক্ত ভিত্তি গড়ার বন্দোবস্ত প্রায় চূড়ান্ত করে ফেলার পথে।
এখনো পর্যন্ত এই ফিতনার বিরুদ্ধে প্রধান ভূমিকা রেখে চলেছেন, সচেতনতা সৃষ্টি করে চলেছেন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, জেনারেল শিক্ষিত দ্বীনের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ কিছু ভাইয়েরা। আল্লাহ তাআলা আমাদের শিক্ষিত দ্বীনদার ভাইদের শ্রমকে কবুল করুন।
ট্রান্সজেন্ডার কী?
ট্রান্স মানে পরিবর্তন, জেন্ডার মানে লিঙ্গ। ট্রান্সজেন্ডার মানে লিঙ্গ পরিবর্তন বা রূপান্তর। ছেলে হয়ে জন্ম হওয়া একজন পরিপূর্ণ সুস্থ, সক্ষম যুবক পরবর্তীতে পুরুষ পরিচয় পরিবর্তন করে নারী পরিচয় গ্রহণ করা। অথবা মেয়ে হয়ে জন্ম হওয়া একজন সুস্থ, সক্ষম যুবতী নারী পরবর্তীতে পুরুষ পরিচয় গ্রহণ করার নামই হচ্ছে ট্রান্সজেন্ডার মতবাদ। (সূত্র: বিশ্ববিখ্যাত জার্ণাল ‘দি নিউ ইংল্যান্ড জার্ণাল অব মেডিসিন’ থেকে প্রকাশিত আর্টিকেল)
ট্রান্সজেন্ডার কিন্তু হিজড়া নয়। তারা জন্মেছে সম্পূর্ণ সুস্থ পুরুষ বা নারী হয়ে। কিন্তু একটি সময়ে এসে তারা নিজেদেরকে বিপরীত লিঙ্গের পরিচয় দেয়। তাদের দাবি হলো কোনো পুরুষ যদি নিজেকে নারী মনে করে তাহলে সে একজন নারীই। চাই সে পুরুষ পুরোপুরি স্বাভাবিক হোক, সন্তানের বাবা হোক এতে কিছুই যায় আসে না। নারী হিসেবেই সমাজ ও রাষ্ট্র তাকে স্বীকৃতি দিতে হবে। অনুরূপ কোনো নারী যদি নিজেকে পুরুষ মনে করে তাহলে সে পুরুষই। চাই তার ঋতুস্রাব হোক বা সে গর্ভবতী হোক তবুও সমাজ ও রাষ্ট্র তাকে পুরুষ হিসেবেই স্বীকৃতি দিতে হবে।
অনেকে আবার বাহ্যিক কিছু অঙ্গের সার্জারি বা হরমোন ট্রিটমেন্ট করে নিজেকে বদলানোর চেষ্টা করে। যদিও পুরোপুরি বদলানো কিছুতেই সম্ভব নয়। তাই নতুন করে তাদের দাবি হলো সার্জারি বা ট্রিটমেন্টের প্রয়োজন নেই। কেউ যদি মনের দিক থেকে নিজেকে নারী বা পুরুষ দাবি করে তাহলেই যথেষ্ট।
পশ্চিমাদের সেই বিকৃত চিন্তা ও রুচি সুকৌশলে আমাদের দেশে আমদানি এবং এর আইনি ভিত্তি দেওয়ার জোর অপচেষ্টা চলছে। শুধু ‘মনে হয়’ এর ওপর ভিত্তি করে আজ একটি অভিশপ্ত মতবাদ তৈরি হয়ে গেছে। পশ্চিমা স্কুলগুলোতেও আজ তা শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। আমাদের দেশেও এমন বস্তাপচা ঘৃণ্য ও পাগলামি মতবাদ সুকৌশলে আমদানির চেষ্টা হচ্ছে।
তৃতীয় লিঙ্গ আর ট্রান্সজেন্ডারের মধ্যে মৌলিক কিছু পার্থক্য
১। তৃতীয় লিঙ্গের শারীরিক অস্বাভাবিকতা আল্লাহ প্রদত্ত। যেখানে তাদের কোনো ক্ষমতা বা হাত নেই। অপরদিকে ট্রান্সজেন্ডারদের শারীরিক কোনো অস্বাভাবিকতা নেই। এর ভিত্তি হলো প্রতারণা ও প্রবৃত্তির চাহিদার উপর।
২। তৃতীয় লিঙ্গ হওয়া জন্মগত ক্রটি। ল্যাবটেস্ট করে জেনেটিক সমস্যার বিষয়টি প্রমাণ করা যায়। কিন্তু ট্রান্সজেন্ডারের জন্মগত কোনো ক্রটি নেই।
৩। তৃতীয় লিঙ্গ জন্মগতভাবে অনেকাংশেই সন্তান জন্মদানে অক্ষম হয়। কিন্তু ট্রান্সজেন্ডাররা সন্তান জন্মদানে পুরোপুরি সক্ষম থাকে। সার্জারি করার দ্বারা তা নষ্ট করে বিকৃত মানসিকতার পরিচয় দেয়।
তৃতীয় লিঙ্গের ব্যাপারে আমাদের দায়বদ্ধতা
তৃতীয় লিঙ্গের ব্যাপারে আমাদের দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। এরা ভাগ্য বিড়ম্বিত এক শ্রেণি হয়ে উঠছে। তাদের বাবা, মা, ভাই-বোন থেকেও যেন নেই। আমাদের সমাজ এদেরকে অবহেলার দৃষ্টিতে দেখে, দূর দূর, ছি ছি করা ব্যতীত আমরা এদের কিছুই দিতে পারি না। রাষ্ট্রও তাদের যথাযথ পুনর্বাসন দিতে পারেনি। ফলে তাদের চাঁদাবাজির কারণে সকলে অতিষ্ঠ। কিন্তু এর আড়ালে যে ভিন্ন অন্ধকার আরেক জগৎ রয়েছে। সে সম্পর্কে আমরা কজনেই খবর রাখি?
মোটকথা, তৃতীয় লিঙ্গরা আমাদের সমাজেরই একটি অবহেলিত অংশ। তাই তৃতীয় লিঙ্গদের জন্য কোটা রাখা, তাদের পুনর্বাসন করা জরুরি। এতে কারও কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু এর সাথে কথিত ট্রান্সজেন্ডারদের একীভূত করা তা হবে চরম ঘৃণিত নোংরা একটি মতবাদকে প্রমোট করা। যা কোনোভাবেই কারো কাম্য নয়।
ট্রান্সজেন্ডারবাদের ফলে যেসব সমস্যা হতে পারে
একজন ছেলে মনে মনে নিজেকে নারী ভাবলে এবং দাবী করলে আর সমাজ ও রাষ্ট্র যদি তার সেই দাবীকে গুরুত্ব দিয়ে তাকে নারী সমাজে গণ্য করে তাহলে ধর্মীয়, সমাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে বহু সমস্যার সৃষ্টি হবে। নিচে তার কিছু তুলে ধরা হলো:
১। একজন ছেলে নিজেকে মেয়ে দাবি করল। সে মতে কর্তৃপক্ষ তাকে মেয়ে হিসেবে গণ্য করে মেয়েদের হোস্টেলে থাকার অনুমতি দিয়ে দিল। তখন প্রকৃত মেয়েদের নিরাপত্তার কী হবে?
২। ছেলে হয়েও নিজেকে মেয়ে দাবি করা কথিত ট্রান্সজেন্ডার লোকটি প্রকৃত মেয়েদের সাথে অবস্থান করলে তখন মেয়েদের সম্ভ্রম ও চরিত্র হননের মোক্ষম সুযোগ গ্রহণ করবে। অনায়াসে অনেক অপকর্মে জড়িয়ে পড়বে। এই নোংরা মতবাদের জন্মভূমিতে এমন অসংখ্য ঘটনা ঘটেই চলেছে।
৩। সমকামিতা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়বে। কারণ ছেলে হয়েও নিজেকে মেয়ে দাবী করা ট্রান্সজেন্ডার মেয়েটি তখন আরেকটি ছেলের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করবে বা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবে। অথচ উভয়ই ছেলে।
৪। একজন প্রকৃত পুরুষ যদি কথিত ট্রান্সজেন্ডার হয়ে নারীদের মত চুল লম্বা করে, বেণী করে, হাতে চুড়ি পরে, কানে দুল পরে, শাড়ি পরে এবং নারীদের বেশভূষা গ্রহণ করে নারী সাজে, তাহলে তার ব্যাপারে হাদিসে কঠোরভাবে নিষেধাজ্ঞা ও হুঁশিয়ারি এসেছে-
অর্থ: রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অভিশাপ দিয়েছেন নারীদের সাদৃশ্য অবলম্বনকারী পুরুষ এবং পুরুষদের সাদৃশ্য অবলম্বনকারী নারীদের উপর। -সহীহ বুখারী, হাদিস নং: ৫৮৮৫
৫। বিবাহিত কোনো পুরুষ যদি হঠাৎ ট্রান্সজেন্ডার হয়ে নিজেকে মহিলা দাবি করে তাহলে সন্তানরা তাকে তখন কী বলে ডাকবে? বাবার পরিবর্তে মা ডাকবে? অনরূপ কোনো মহিলা যদি হঠাৎ ট্রান্সজেন্ডার হয়ে পুরুষ সাজে বা দাবি করে। তাহলে তার সন্তানেরা তাকে বাবা বলেই ডাকবে? না মা বলে ডাকবে? কোনোটি?
৬। মিরাস তথা ত্যাজ্য সম্পত্তি বণ্টনে জটিলতা। কারণ, আজীবন মেয়ে হয়ে থাকা একজন নারী যদি হঠাৎ পুরুষ বলে দাবি করে বসে তখন কি তাকে অন্যান্য ভাইদের মতো সমঅংশ দিতে হবে? অনুরূপ আজীবন ছেলে হয়ে থাকা একজন হঠাৎ যদি মেয়ে দাবি করে বসে। তখন তাকে কিসের ভিত্তিতে মিরাস দেওয়া হবে?
৭। চাকুরিসহ অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দিবে। প্রকৃত নারীর কোটায় কথিত ট্রান্সজেন্ডার নারী (যে আসলে পুরুষ) সে ইন্টারভিউ দিয়ে জয়েন করতে চাইবে। তাছাড়া আরও বহু নিত্য নতুন সমস্যা সষ্টি হতে পারে।
ট্রান্সজেন্ডারবাদের ভয়াবহ কুফল
অভিশপ্ত ও ঘৃণিত এই ট্রান্সজেন্ডারবাদ এর ভয়াবহ কুফল পশ্চিমা সমাজে ইতোমধ্যে পড়তে শুরু করেছে। এর নমুনা হচ্ছে, ২০২৩ সালের শুরুতে ট্রান্সজেন্ডার নারী (আসলে কিন্তু পুরুষ) প্রকৃত আরেক রুমমেট নারীকে ধর্ষণ ইস্যুতে চরম আন্দোলনের ফলে স্কটল্যন্ডের প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগে বাধ্য হন।
আরও পড়ুন: ট্রান্সজেন্ডার, তৃতীয় লিঙ্গ; এক নাকি ভিন্ন
এরকম আরও বহু ঘটনা ঘটেই চলেছে। অপরদিকে এই অভিশপ্ত ও ঘৃণিত মতবাদটি বাংলাদেশের মতো একটি মুসলিম অধ্যুষিত দেশে আমদানির অপচেষ্টা চলছে। গত ২১ সেপ্টেম্বর ট্রান্সজেন্ডার অধিকার সুরক্ষা আইন ২০২৩ এর খসড়া উপস্থাপনা করা হয়েছে। আমরা মনে করি, সরকারকে ভুল বুঝিয়ে অসভ্য এবং মারাত্মক কুরুচিপূর্ণ কিছু ব্যক্তি ও সংগঠন এই আইন তৈরি ও পাস করাতে জোর চেষ্টা চালাচ্ছে। আমাদের বিশ্বাস সরকার এ বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন থাকবে।
আমাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য
মুসলমানদের ঈমান আকিদা বিরোধী। ইসলামের সঙ্গে সুস্পষ্ট সাংঘর্ষিক। মানবতা বিরোধী এবং মানবিক রুচি ও চাহিদার সম্পূর্ণ বিপরীত এই ট্রান্সজেন্ডার ইস্যুটি এদেশে আমদানি করার কোনো যুক্তি নেই। পশ্চিমারা রুচি ও বিবেকবর্জিত অনেক কিছুই করে থাকে। এমনকি তাদের মধ্যে এখন কুকুর-শৃগাল হওয়ারও প্রবণতা দিন দিন বাড়়ছে। কুকুরের বেশভূষা ও চলাফেরা ধারণ করতে বিকৃত রুচির মানুষের সংখ্যা অনেক। তাই বলে কি আমাদের দেশেও সেরকম কিছু করতে হবে?
শেষ কথা ও করণীয়
আসুন এর বিরুদ্ধে আমরা সোচ্চার হই। নিজের প্রজন্ম ও সমাজকে বাঁচানোর লক্ষ্যে সচেতনতা গড়ে তুলি। সোশ্যাল মিডিয়া, জুমার বয়ান ও ওয়াজ মাহফিলে এটির নিষিদ্ধতা ও ক্ষতির দিকগুলো তুলে ধরি। যাদের পক্ষে সম্ভব সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারক মহলের সাথে বিষয়টির ভয়াবহতা নিয়ে আলোচনা পর্য়ালোচনা করি। প্রজন্মকে এ রকম ভয়াবহ ফিতনা থেকে বাঁচাতে পারিবারিক তালিম ও ঘরোয়া শিক্ষা জোরদার করি। আল্লাহ তা’আলা আমাদের সহায় হোন।
বাংলাবার্তা/জেডএইচ