বৃহস্পতিবার, ০১ জুন ২০২৩, জ্যৈষ্ঠ ১৭ ১৪৩০

বাংলা বার্তা || Bangla Barta

গণঅভ্যুত্থান দিবস

গণঅভ্যুত্থান : পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ

প্রকাশিত: ১০:৩৪, ২৪ জানুয়ারি ২০২৩; আপডেট: ১০:৩৬, ২৪ জানুয়ারি ২০২৩

গণঅভ্যুত্থান : পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ

ফাইল ছবি

জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে ১৯৬৯-এর ২৪ জানুয়ারি এক ঐতিহাসিক দিন। ১৯৬৬-৬৭-তে আমি ইকবাল হল (শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ছাত্র সংসদের সহসভাপতি এবং ১৯৬৭-৬৮-তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ তথা ডাকসুর সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করি। বঙ্গবন্ধু যখন ছয় দফা দেন, আমি তখন ইকবাল হলের সহসভাপতি। ছয় দফা দেওয়ার পর দেশের বিভিন্ন জেলায় বঙ্গবন্ধুর নামে ১০টি মামলা করা হয়। প্রতিটি মামলায় জামিন পেলেও নারায়ণগঞ্জ থেকে সভা করে ঢাকায় ফেরার পর 'পাকিস্তান দেশরক্ষা আইনে' তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রতিবাদে আওয়ামী লীগের ডাকে ৭ জুন সর্বাত্মক হরতালে ছাত্রলীগ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। '৬৮-এর ১৮ জানুয়ারি জেল থেকে বঙ্গবন্ধু মুক্তি পেলেও পুনরায় জেলগেটেই গ্রেপ্তার করে অজানা স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। '৬৮-এর ১৯ জুন আগরতলা মামলার বিচার শুরু হলে আমরা বুঝতে পারি, আইয়ুব খান রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ তুলে বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসিকাষ্ঠে মৃত্যুদণ্ড দেবেন। আইয়ুব খান প্রদত্ত মামলার নামই ছিল 'রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য'।

মনে পড়ছে, ডাকসুসহ চারটি ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে ঐতিহাসিক ১১ দফার ভিত্তিতে '৬৯-এর ৪ জানুয়ারি সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গড়ে ওঠার কথা। মনে পড়ে, ১১ দফা আন্দোলনের প্রণেতা-ছাত্রলীগ সভাপতি প্রয়াত আবদুর রউফ ও সাধারণ সম্পাদক খালেদ মোহাম্মদ আলী, ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপ) সভাপতি প্রয়াত সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক ও সাধারণ সম্পাদক সামসুদ্দোহা, ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ) সভাপতি মোস্তফা জামাল হায়দার ও সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল্লাহ এবং এনএসএফের একাংশের সভাপতি প্রয়াত ইব্রাহিম খলিল ও সাধারণ সম্পাদক ফখরুল ইসলাম মুন্সীর কথা। আমি ডাকসুর ভিপি হিসেবে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সমন্বয়ক ও মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করি। আমার সঙ্গে ছিলেন ডাকসুর জিএস নাজিম কামরান চৌধুরী।

'৬৯-এর ১৭ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের বটতলায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ১১ দফা প্রণয়নের পর এটিই প্রথম কর্মসূচি। আমার সভাপতিত্বে সভা শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে গভর্নর মোনায়েম খান ১৪৪ ধারা জারি করেন। ১৪৪ ধারা ভঙ্গের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে শ-পাঁচেক ছাত্র নিয়ে রাজপথে এলাম। পুলিশ বাহিনী আমাদের ওপর লাঠিচার্জ করে। ছাত্রলীগ সভাপতি আবদুর রউফ ঘটনাস্থলে আহত হন। আমরা ক্যাম্পাসে ফিরে আসি। পরদিন ১৮ জানুয়ারি পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল ও ঢাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ধর্মঘট কর্মসূচি দিই।

১৮ জানুয়ারি বটতলায় জমায়েত। যথারীতি আমি সভাপতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র ধর্মঘট ছিল বিধায় সকালে বটতলায় ছাত্র জমায়েতের পর খণ্ড খণ্ড মিছিল এবং সহস্র কণ্ঠের উচ্চারণ- 'শেখ মুজিবের মুক্তি চাই, আইয়ুব খানের পতন চাই'। ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নিয়ে রাজপথে নেমে এলাম। দাঙ্গা পুলিশ লাঠিচার্জ আর টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। ফিরে এলাম ক্যাম্পাসে। কর্মসূচি নেওয়া হলো- ১৯ জানুয়ারি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিছিল করব এবং ১৪৪ ধারা ভাঙব। মিছিলে পুলিশ লাঠিচার্জ ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। একপর্যায়ে পুলিশ গুলি চালাল। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রলীগ কর্মী আসাদুল হক গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়ে রাজপথে। '৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে সে শহীদ হয়। পুলিশের নির্যাতন ও গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে ২০ জানুয়ারি আবার বটতলায় সমাবেশের কর্মসূচি দিই। এদিন ১১ দফা দাবিতে ঢাকাসহ প্রদেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পূর্ণ ধর্মঘট পালিত হয়। সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্তক্রমে সেদিন বলেছিলাম, 'যত দিন আগরতলা মামলার ষাড়যন্ত্রিক কার্যকলাপ ধ্বংস করে প্রিয় নেতা শেখ মুজিবসহ সকল রাজবন্দিকে মুক্ত করতে না পারব, তত দিন আন্দোলন চলবে। স্বৈরশাসক আইয়ুব-মোনায়েমশাহির পতন না ঘটিয়ে বাংলার ছাত্রসমাজ ঘরে ফিরবে না।' পুনরায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গের ঘোষণা দিলাম।

লাখো মানুষের মিছিল নেমে এলো রাজপথে। কোথায় গেল ১৪৪ ধারা! মিছিল যখন আগের কলাভবন, বর্তমান মেডিকেল কলেজের সামনে- ঠিক তখনই গুলি শুরু হয়। আমাদের লক্ষ্য করে এক পুলিশ ইন্সপেক্টর গুলি ছোড়ে। গুলি লাগে আসাদুজ্জামানের বুকে। তাকে ধরাধরি করে মেডিকেল কলেজের দিকে নেওয়ার পথে আমাদের হাতের ওপরেই সে মৃত্যুবরণ করে। মেডিকেলের সিঁড়িতে আসাদের লাশ রাখা হয়। তার গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত শার্টটি সংগ্রামের পতাকা করে আমরা আসাদের রক্ত ছুঁয়ে শপথ নিয়ে সমস্বরে বলি- 'আসাদ তুমি চলে গেছো। তুমি আর ফিরে আসবে না আমাদের কাছে। তোমার রক্ত ছুঁয়ে শপথ করছি, আমাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা মায়ের কোলে ফিরে যাব না।'

শহীদ মিনার থেকে শুরু হওয়া শোক মিছিল মুহূর্তেই লাখো মানুষের বিক্ষোভ মিছিলে পরিণত হলো। ইতোমধ্যে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। শোক মিছিল যখন তিন নেতার সমাধির কাছে, তখন সেনাসদস্যরা মাইকে বলছে, 'ডোন্ট ক্রস, ডেঞ্জার-ডেঞ্জার, ডোন্ট ক্রস!' 'ডেঞ্জার' শব্দের কোনো মূল্যই নেই মিছিলের কাছে। ২১ জানুয়ারি পূর্বঘোষিত হরতাল কর্মসূচি পালিত হলো। ২২ জানুয়ারি ঢাকা নগরীতে এমন কোনো লোক দেখিনি, যাঁর বুকে কালো ব্যাজ নেই। বাড়িতে, অফিসে সর্বত্রই কালো পতাকা উড়ছে।

২৩ জানুয়ারি ঢাকা পরিণত হয় মশালের নগরীতে। ২৪ জানুয়ারি সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। কিছুক্ষণের মধ্যে সেনাবাহিনী, ইপিআর ও পুলিশ মরিয়া হয়ে ওঠে বিক্ষোভ দমনে। যত্রতত্র গুলি চালাতে থাকে। সে গুলিতেই শহীদের তালিকায় যুক্ত হয় মতিউর, মকবুল, আনোয়ার, রুস্তম, মিলন, আলমগীর, আনোয়ারাসহ অনেক নাম। লাখো মানুষ নেমে আসে ঢাকার রাজপথে। মানুষের পুঞ্জীভূত ঘৃণা এমন ভয়ংকর ক্ষোভে পরিণত হয়, বিক্ষুব্ধ মানুষ সরকারি ভবন ও সরকার সমর্থিত পত্রিকায় আগুন ধরিয়ে দেয়। 'দৈনিক পাকিস্তান', 'মর্নিং নিউজ' ও 'পয়গাম' অফিস ভস্মীভূত হয়। আগরতলা মামলার প্রধান বিচারপতি এস রহমান বাসভবন থেকে এক বস্ত্রে পালিয়ে যায়।

ঢাকার নবকুমার ইনস্টিটিউশনের দশম শ্রেণির ছাত্র মতিউর রহমানের লাশ নিয়ে আমরা পল্টনে যাই। লাখ লাখ মানুষের অংশগ্রহণে পল্টন ময়দানে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজার পর বিক্ষুব্ধ জনতা গভর্নর হাউস আক্রমণে উদ্যত হয়। বিনা মাইকে বক্তৃতা করে জনতাকে শান্ত করি। কারফিউর মধ্যেই মতিউরের লাশ নিয়ে যাই ন্যাশনাল ব্যাংক কলোনিতে। তার মা শুধু আঁচলে চোখ মুছে বলেন, 'আমার ছেলে চলে গেছে, দুঃখ নাই! আজ থেকে তুমি আমার ছেলে। মনে রেখো, যে জন্য আমার ছেলে রক্ত দিয়ে গেল, সেই রক্ত যেন বৃথা না যায়।' 

'৬৯-এর ২৪ জানুয়ারি গণআন্দোলন-গণবিস্ম্ফোরণের মধ্য দিয়ে সংঘটিত হয় গণঅভ্যুত্থান। কারফিউর মধ্যে একদিনও থেমে থাকেনি

আমাদের সংগ্রাম। দেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে পাকিস্তানি প্রশাসন বর্জন করেছে। কলকারখানা, অফিস-আদালত, সচিবালয় সর্বত্র প্রশাসন ভেঙে পড়েছে। সরকারি কর্মকর্তারা জনগুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন সিদ্ধান্তের জন্য ধরনা দিতেন ইকবাল হলে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের কাছে। এ দিনগুলো ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে চিরদিন।

তোফায়েল আহমেদ : আওয়ামী লীগ নেতা; সংসদ সদস্য; সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি 
[email protected]

Right Side Advertisement
Right Side Advertisement
Middle Advertisement
Middle Advertisement Mobile

Warning: filesize(): stat failed for xhtml/gen_breaking.htm in /mnt/volume_sgp1_05/bangla4barta6bd0/public_html/common/scrollBreaking.php on line 1

শীর্ষ সংবাদ:

বাংলাদেশে কিছু দিন ধরে আবারও ডেঙ্গুর সংক্রমণ বাড়ছে সুদানে বাংলাদেশ দূতাবাসে গুলি বাংলাদেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নিয়েছেন মো. সাহাবুদ্দিন বঙ্গবাজারে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের ৯ কোটি টাকা দিলেন প্রধানমন্ত্রী সুখবর দিল আবহাওয়া অধিদপ্তর, ৩ বিভাগে বৃষ্টি হতে পারে ৪১ ডিগ্রি ছাড়াল ঢাকার তাপমাত্রা, ৫৮ বছরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি পেরিয়ে যেতে পারে, বলছে আবহাওয়া অধিদপ্তর ঈদে পদ্মাসেতুতে নয়, মহাসড়কে চলবে মোটরসাইকেল বঙ্গবাজারে ফায়ার সার্ভিস অফিসে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর নাটোরে কলেজছাত্রীকে অপহরণ ও ধর্ষণ মামলায় ছয়জনের মৃত্যুদণ্ড দেশের ৩০০ আসনেই ব্যালট পেপারে ভোটগ্রহণ করা হবে ১২ কেজি এলপিজি সিলিন্ডারের দাম কমলো ২৪৪ টাকা এ বছর জনপ্রতি সর্বোচ্চ ফিতরা ২৬৪০, সর্বনিম্ন ১১৫ টাকা কাভার্ডভ্যান কেড়ে নিল নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর প্রাণ হাইকোর্টের রায়ে উপজেলা পরিষদে একচ্ছত্র কর্তৃত্ব হারালেন ইউএনওরা ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় স্বামী-স্ত্রী নিহত দেশেজুড়ে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনায় উদযাপন করা হচ্ছে স্বাধীনতা দিবস গণহত্যা দিবসের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানহানি মামলায় কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীর দুই বছরের কারাদণ্ড প্রযোজক রহমত উল্লাহর বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেছেন নায়ক শাকিব খান প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর পেল আরও ৩৯ হাজার ৩৬৫ গৃহহীন পরিবার দেশে কোটিপতির সংখ্যা এখন এক লাখ ৯ হাজার ৯৪৬ জন দেশে ১৭ দিনে রেমিট্যান্স এলো ১২ হাজার কোটি টাকা হজযাত্রীদের জন্য প্লেন ভাড়া কমানো সম্ভব নয়, জানালেন বিমানের এমডি চলতি বছরের হজযাত্রীদের প্রথম ফ্লাইট ২১ মে মাদারীপুরের শিবচরে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে ১৯ ঢাকাই সিনেমার জনপ্রিয় চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহি গ্রেফতার সিলেটে অনুশীলনে চোট পেয়ে হাসপাতালে মেহেদি মিরাজ টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর প্রতি রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা ভোলায় ৪ জনের প্রাণ কেড়ে নিল যাত্রীবাহী বাস পরিবর্তন আসছে বিসিএস নন-ক্যাডার নিয়োগে মার্চ মাসে প্রতিদিন দেশে প্রবাসী আয় আসছে ৭৩০ কোটি টাকা জুনের মধ্যে পাঁচ সিটি কর্পোরেশনে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসি রূপগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ফরিদ ভূঁইয়া মাসুমের বাড়িতে সন্ত্রাসী তাওলাদ বাহিনীর গুলি বর্ষণ